সামরিক বসন্তে ফুটেছে ‘সালওয়া’ ফুল!

ছবি: সংগৃহীত
মাটি কাঁদতে জানলে তার অশ্রুর রং হতো ‘লাল’! বিশ্বের নানা প্রান্তে শত-সহস্র লড়াই-সংঘাতে যত মানুষের রক্ত মাটিতে মিশেছে, মাটিকে মাটি বলে চেনা দায়। রুধির রঞ্জিত মাটি ক্রমে নিজের রং হারাচ্ছে। তবু তার স্বর নেই বলে পৃথিবীর বুকে এখনো নৈঃশব্দ নামে। অবশ্য এর চেয়ে অধিক ‘নীরব’ বিশ্ব মাতব্বরেরা। তারা নিজেদের স্বার্থের বাইরে এক বর্ণও রা কাড়েন না, বলার কথাটি স্রেফ গিলে খান। আর তাই রক্ত ঝরছে অবিরাম, প্রতিকারহীন! বিশ্বে এখন সামরিক বসন্ত। এমন বসন্ত দিনে যত বেশি রক্ত ঝরে, তত বেশি অস্ত্র বিক্রি বাড়ে। যত বেশি সংঘাত, তত বেশি লাভ!
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের বার্ষিক প্রকাশনা দ্য মিলিটারি ব্যালেন্স বলছে, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী সামরিক ব্যয় বেড়েছে ৪ শতাংশ, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, বিশ্বের বুকে কিসের স্পন্দন, মুখে কী ভাষা! নানা ফন্দি-ফিকিরে জিইয়ে রাখা দুনিয়ার দশ দিকের সংঘাত-সহিংসতায় বাস্তুচ্যুত হাজারো-লাখো মানুষের মুখমণ্ডলে এই রক্তক্ষয়ী সময়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজতে চাওয়ার তাই মানে নেই কোনো। স্বজন-সংসার, স্বভূমি হারানো এসব মানুষের সংখ্যায় নির্ণীত হয় কেবল অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভালাভের হিসেব! শরণার্থী শিবিরে অনাহারে-অর্ধাহারে থাকা লাখো শিশুর অন্ধকার ভবিষ্যত্ গড়ে দেয় যুদ্ধবাজদের ‘সোনালি’ দিন। বেঘোরে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা যত বাড়ে, যুযুধান পক্ষগুলোর আক্রমণ-হামলা তত ‘বৈধতা’ পেতে থাকে। অস্ত্র বিক্রি বাড়ে তাই লাফিয়ে লাফিয়ে।
মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন সব কাগজে শোভা পাওয়ার জিনিস; পরিসংখ্যান-গবেষণা-সুপারিশ সব সভা-সেমিনারকে প্রাণবন্ত করার উপাদান! এমন বৈশ্বিক ব্যবস্থায় সামরিক তাকত বাড়ানোর অপর নাম ‘প্রতিরক্ষা ব্যয়’। মোটা দাগে, এই অস্ত্রবাজি রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্রের প্রতিযোগিতার ফল। যে প্রতিযোগিতার মূল কথা নিজের সুরক্ষা বলা হলেও আদতে তা অন্যকে ঘায়েলে সামর্থ্যবান হওয়ার সূচক। তাই অস্ত্রের চাহিদা ও যোগানে রক্ত ঝরা অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর বলাই বাহুল্য, মিলিটারি ব্যালেন্সের পুরো প্রতিবেদন না পড়েও বাজি ধরে বলা যায়, অস্ত্রবাজারের প্রধান নিয়ন্ত্রক যুক্তরাষ্ট্র।
সুইডেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) আরো জানাচ্ছে, চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান আরো সুসংহত করার লক্ষ্যে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্রবাহিনীকে আধুনিকায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে অস্ত্র বিক্রিতে আগের চেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছে দেশটির অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। হিসাব বলছে, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সামরিক ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। চীন ২০১৩ সাল থেকে প্রতিবছর তার জিডিপির ১ দশমিক ৯ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে চলেছে। এর জেরে কয়েক বছর ধরেই পুরো এশিয়ায় সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষণীয়। এই এলাকার জাতীয় আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গত এক দশকে সামরিক ব্যয় বেড়েছে ৫০ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাজনিত অস্থিতিশীলতার কারণেই এই অস্ত্রের ঝনঝনানি বলে জোরালো অভিমত পর্যবেক্ষকদের। তাদের ভাষ্য:স্নায়যুদ্ধ-পরবর্তী অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির বিষয়টিকেই উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। মিলিটারি ব্যালেন্সের মতও অভিন্ন। আইএনএফ চুক্তির বিদায়ের পর চীনা অস্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। যদিও প্রকৃত চুক্তির অংশীদার চীন ছিল না। অন্যদিকে, রাশিয়ার আচরণ নিয়ে অস্বস্তির জেরে সামরিক ব্যয় বাড়ছে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোতে। জার্মানি বলছে, ইউরোপে সামরিক ব্যয় বাড়ার মূল কারণ আইএস। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে জার্মানির সামরিক ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৯ শতাংশের বেশি।
মিলিটারি ব্যালেন্সের পর্যবেক্ষণ বলছে, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর কৌশলগত অবস্থান যুদ্ধাবস্থা তৈরিতে বড়ো ভূমিকা রাখছে। তারা সরাসরি যুদ্ধে না গিয়েও এমন কৌশল নির্ধারণ করছে যা আঁচ বাড়াচ্ছে। রাশিয়ার ক্রিমিয়া আগ্রাসন, যুক্তরাজ্যে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ বা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগের মতো বিষয়গুলোও এসেছে মিলিটারি ব্যালেন্সের পর্যালোচনায়। বাদ যায়নি ইরানের তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যুদ্ধ চালানোর সক্ষমতার বিষয়টিও। সুতরাং বিশ্বজুড়ে অস্ত্র বিক্রি বাড়ার কারণ দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ চাহিদা শুধু নয়, বাইরেও অস্ত্রের চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। সুতরাং সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, লেবানন, ফিলিস্তিন ইত্যাদি দেশে-ভূখণ্ডে হররোজ কত শত মানুষ মরছে তার তথ্য উপস্থাপন অর্থহীন। অস্ত্র-বিছানো বিশ্বে বেঘোরে প্রাণ হারানোই এখন লাখো-কোটি আদম সন্তানের নিয়তি। তাই স্বাভাবিক মৃত্যুহীন এ সময়ে যতক্ষণ বাঁচবে তা-ই ‘বোনাস’! এই ‘বোনাস’ সময় উপভোগ করার কায়দাটা রপ্ত করতে পেরেছে তিন বছরের সিরীয় শিশু সালওয়া। গুলি-গোলা-বোমা-মিসাইলের মুহুর্মুহু শব্দে সে খিলখিল হাসতে শিখেছে!
সালওয়া, তোমার এই হাসির শব্দে অস্ত্রের ঝনঝনানি কিছুমাত্র ম্লান হবে না জানি,অস্ত্র কারবারিদের কানে গলিত সিসাও হবে না তা, তবু মাইন পোঁতা ভূমিতে তুমিই আমাদের ফুল চাষি!
লেখক : হাসান ইমাম
সাংবাদিক

Comments