চীন-মার্কিন বাণিজ্য চুক্তিতে বিশ্ব বাণিজ্যে স্তস্তির ইঙ্গিত

ছবি-সংগৃহীত
দীর্ঘ ১৮ মাস বাণিজ্যযুদ্ধের অবসানে একটি চুক্তি সই করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। কিন্তু এরই মধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েছে। অবশ্য চুক্তির পর উভয় পক্ষই বিষয়টিকে ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। চীনা নেতারা এই চুক্তিকে বলছেন ‘উইন-উইন’। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন, চুক্তি মার্কিন অর্থনীতিতে পরিবর্তন ঘটাবে। এতে উভয় দেশের সম্পর্ক আরো জোরালো হবে। আর বিশ্ববাণিজ্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো মনে করছে, এটি উভয় দেশের চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ কমে আসার লক্ষণ, যার ফলে অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তায় থাকা বিশ্ববাণিজ্যে স্বস্তি ফিরতে পারে।
অবশ্য চুক্তিতে উভয় দেশই কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। এছাড়া যে কোনো ইস্যুতে চুক্তি থেকে বের হয়ে আসারও পথ খোলা রেখেছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চীনের পণ্যের ওপর আরোপিত ট্যারিফ কমানোর বড়ো ধরনের ঘোষণাও আসেনি। কিছু শর্ত মানার বিনিময়ে নির্দিষ্ট সীমার পণ্যে ট্যারিফ কাঠামোতে পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে।
ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী লিউ হের মধ্যে বুধবার এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়িয়ে ২০০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে নিয়ে যাবে, যা ২০১৭ সালের সমপরিমাণ হবে। নকল ঠেকাতে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেবে চীন। আর ট্রেড সিক্রেট চুরির ব্যাপারে কোম্পানিগুলোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া সহজতর করবে। অর্থাত্ মেধাস্বত্ব আইন শক্তিশালী করবে। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর আরোপিত নতুন শুল্কের কিছুটা অর্ধেক করে দিতে সম্মত হয়েছে। ৩৬০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত চীনা পণ্য আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে যুক্তরাষ্ট্র। অপরপক্ষে চীন, ১০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত মার্কিন পণ্য আমদানিতে শুল্ক কাঠামো পুনর্বিন্যাস করবে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে পণ্য আমদানি করেছিল প্রায় ৫৪০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ।
উভয় দেশের এই চুক্তিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশি শিল্পোদ্যোক্তা ও রপ্তানিকারকরাও। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, চুক্তিতে ট্যারিফ কমানোর বিষয়ে বড়ো ধরনের কোনো পরিবর্তনের বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। আগে যা ছিল, প্রায় তাই আছে। ফলে উভয় দেশের বিদ্যমান বাণিজ্য পরিস্থিতিতে কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বাণিজ্য চুক্তির পুরো প্রভাব বুঝতে কয়েক বছর সময় লেগে যাবে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে জিও-টেকনোলজিক্যাল বিশেষজ্ঞ পল টিওলোর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, প্রথম দফার বাণিজ্য চুক্তি উভয় দেশের মধ্যকার উত্তেজনা প্রশমনে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এটি দুই দেশের প্রযুক্তিগত দ্বন্দ্বও অনাস্থা কতটুকু কমাবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
একটি বাণিজ্য চুক্তি সত্ত্বেও বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যকার প্রযুক্তিগত বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি বাড়ছে। চীনা টেলিকম কোম্পানি হুয়াওয়ে এবং আরো কিছু কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো তাদের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারছে না। আবার বেইজিংও একই ধরনের কালো তালিকা করেছে। মনে করা হচ্ছে, আমেরিকায় থাকা চীনা কোম্পানিগুলোকে পর্যবেক্ষণের আওতাতে রাখবে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে এক্ষেত্রে কী অগ্রগতি আসে, তা দেখতে আরো অপেক্ষা করতে হবে।
অবশ্য পালটাপালটি ট্যারিফ আরোপের ফলে উভয় দেশের বাণিজ্য কমেছে ব্যাপক হারে। এতে দুই দেশের পাশাপাশি পুরো বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রধান ক্রিস্টালিনা জারজিয়েভা বলেছেন, এই যুদ্ধে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৯ সালের প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা ৩ শতাংশ কমিয়েছে। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের সঙ্গে তার দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে—এমন বিবেচনায় স্বস্তি পেতে পারেন। কিন্তু ইতিমধ্যে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য কমেছে প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলারের।
এই বাণিজ্য যুদ্ধে মার্কিন কৃষকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ চীনে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিজাত রপ্তানি আড়াই হাজার কোটি ডলার থেকে কমে এখন ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের নিচে নেমেছে। যদিও চীনে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ অনেকটাই স্থিতিশীল ছিল এই বাণিজ্য যুদ্ধের সময়েও। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে চীনা বিনিয়োগ কমেছে ব্যাপকভাবে। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের হিসাবে, যুক্তরাষ্ট্রে চীনা কোম্পানির বিনিয়োগ ২০১৬ সালে ছিলো ৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার, আর ২০১৮ সালে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ৯০৭ কোটি ডলার। আর ২০১৯ সালের প্রথমমার্ধে তা নেমে এসেছে মাত্র ২৫ কোটি ডলারে।
ইত্তেফাক/এসইউ
Comments