জাপানের সুপ্ত দারিদ্র্য: কিছু অজানা তথ্য
- Get link
- X
- Other Apps

জাপানের সাম্প্রতিক কালের অর্থনৈতিক সংস্কার সংখ্যাগত হিসাবের দিক থেকে বেকার জনসংখ্যা হ্রাস করলেও বেড়ে চলেছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। একই সঙ্গে আয়ের বৈষম্য গড়ে তুলছে এমন এক বৈসাদৃশ্যের সমাজ, জাপানে আগে যা কখনো সেভাবে দেখা যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে জাপান হয়ে পড়েছিল ক্ষুধার্ত এক দেশ। তবে সেই অবস্থা ছিল যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফলাফল। ত্রুটিপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মসূচির কারণে তা হয়নি, যেমনটা দেখা যাচ্ছে ইদানীং।

অন্যদিকে, আপেক্ষিক দারিদ্র্য সেই অর্থে সরাসরি ক্ষুধার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। অর্থাৎ মানুষের আয় সেখানে অঙ্কের হিসাবে খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে সক্ষম হলেও বিরাজমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি এর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, মানুষকে অনাহার ও অপুষ্টিতে ভুগতে হয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সম্পদের অভাবের তুলনায় ত্রুটিপূর্ণ অনুসৃত নীতিমালা বেশি দায়ী। ধনী দেশগুলোতে সাধারণত সে রকম দারিদ্র্য সহজেই চোখে পড়ে। তবে দারিদ্র্যকে যে সংজ্ঞাভুক্তই করা হোক না কেন, এর ফলাফল কিন্তু শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় একই রকম। অর্থাৎ এর ফলে কষ্ট পেতে হয় সাধারণ মানুষকেই। জাপানে এখন এই আপেক্ষিক দারিদ্র্য আর লুকিয়ে রাখার পর্যায়ে নেই। সুপ্ত অবস্থা থেকে জেগে উঠে এই দারিদ্র্য এখন হিংস্র চেহারা দেখাতে শুরু করেছে। এর সহজ শিকার হতে হচ্ছে জাপানের শিশুদের।
জাপানজুড়ে আজকাল ‘ফুড ব্যাংক’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠা একধরনের কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। সাধারণত স্কুলের দীর্ঘ ছুটির দিনগুলোয় এই ফুড ব্যাংক সক্রিয় হয়ে ওঠে। এদের কাজ মূলত দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য খাদ্যের সরবরাহ পাঠানো। টোকিও, কিওতো, শিজুওকা ও অন্য কয়েকটি জেলায় শিশুদের জন্য বিনা মূল্যের এই সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
শিশু দারিদ্র্যের এই বিষয় নিয়ে জাপানে প্রথম জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা হতে দেখা গেছে প্রায় এক দশক আগে। দেশের নেতৃস্থানীয় শিক্ষা ও গবেষণামূলক বইপত্রের প্রকাশনা সংস্থা আকাশি শোতেন ‘শিশু দারিদ্র্যের শ্বেতপত্র’ শিরোনামে এক বই প্রকাশ করেছিল। তাতে গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময়ে শিশুদের দেহের ওজন হ্রাস পাওয়ার ওপর আলোকপাত করে উল্লেখ করা হয়েছিল যে বিষয়টি ক্রমেই বড় আকারের এক সামাজিক সমস্যা হয়ে উঠছে। এরপর থেকেই বেসরকারি পর্যায়ে শিশু দারিদ্র্য নিয়ে আরও বিস্তৃত আলোকপাত শুরু হয় এবং সেই পথ ধরেই পরবর্তী সময়ে ‘ফুড ব্যাংক’ নামের জাতীয় সামাজিক কার্যক্রমের সূচনা।
শিশু দারিদ্র্যের এই বিষয় নিয়ে জাপানে প্রথম জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা হতে দেখা গেছে প্রায় এক দশক আগে। দেশের নেতৃস্থানীয় শিক্ষা ও গবেষণামূলক বইপত্রের প্রকাশনা সংস্থা আকাশি শোতেন ‘শিশু দারিদ্র্যের শ্বেতপত্র’ শিরোনামে এক বই প্রকাশ করেছিল। তাতে গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময়ে শিশুদের দেহের ওজন হ্রাস পাওয়ার ওপর আলোকপাত করে উল্লেখ করা হয়েছিল যে বিষয়টি ক্রমেই বড় আকারের এক সামাজিক সমস্যা হয়ে উঠছে। এরপর থেকেই বেসরকারি পর্যায়ে শিশু দারিদ্র্য নিয়ে আরও বিস্তৃত আলোকপাত শুরু হয় এবং সেই পথ ধরেই পরবর্তী সময়ে ‘ফুড ব্যাংক’ নামের জাতীয় সামাজিক কার্যক্রমের সূচনা।
টোকিওর পশ্চিমে অবস্থিত কোমায়ে শহর গত বছর থেকে গ্রীষ্মের ছুটির সময়ে শিশুদের জন্য খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি চালু করেছে। একক অভিভাবকের পরিবারগুলোর জন্য তিন কিলোগ্রাম ওজনের যেসব বাক্স এরা পাঠাচ্ছে, তাতে চাল, নুডলস ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী রাখা থাকে। গ্রীষ্মের ছুটি চলার সময় দরিদ্র পরিবারের শিশু সন্তানদের যেন অভুক্ত না থাকতে হয়, সে জন্য এই ব্যবস্থা। প্রশ্ন হচ্ছে, জাপানের শিশুদের একটি অংশকে কেন গ্রীষ্মের ছুটির সময় অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে?

এই সমস্যা বিশেষত জাপানের শহরতলি ও মফস্বল এলাকার শহরগুলোয় ব্যাপক। কতটা ব্যাপক তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় কোমায়ে শহরে চালানো এক জরিপে। সেখানে ৪০ শতাংশের বেশি একক অভিভাবকের পরিবার বলেছে যে গত এক বছরে আর্থিক দিক থেকে সমস্যার মুখে পড়তে হওয়ায় তারা প্রয়োজনীয় পরিমাণে নিত্যপণ্য কিনতে পারেনি।
টোকিওর উত্তরে ফুজি পাহাড়সংলগ্ন ইয়ামানাশি জেলা ফুড ব্যাংক চালু করেছে আরও আগে, ২০১৫ সালে। এই উদ্যোগের পেছনে আছে করুণ এক কাহিনি। জেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক ছাত্র গ্রীষ্মের ছুটিতে স্কুলে উপস্থিত হয়ে সেখানে দায়িত্বে থাকা শিক্ষকের কাছে জানতে চেয়েছিল, কোনো খাবার স্কুলে আছে কি না। ছেলেটি ছিল অভুক্ত এবং ক্ষুধার তাড়নাই তাকে স্কুলে নিয়ে যায়। সেই শিক্ষক পরে নিজে উদ্যোগী হয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করলে সমস্যার ব্যাপ্তি তাঁর মতো আরও অনেকের চোখে ধরা দেয়। তখন থেকেই এই জেলায় গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে ছাত্রদের অভুক্ত থাকার সমস্যা সমাধানে খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি চালু করা হয়। ইয়ামানাশি জেলা এখন সেই কর্মসূচি আরও বিস্তৃত করে আটটি শহরের সঙ্গে শিশু দারিদ্র্য নিয়ে তথ্য আদান-প্রদান করছে এবং দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য খাদ্য সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। ইয়ামানাশি ফুড ব্যাংক চলতি গ্রীষ্মে ৬২৪টি পরিবারের মোট ১ হাজার ৩১২টি শিশুর জন্য খাদ্য সাহায্য পাঠানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। একই ধরনের কর্মসূচি এখন নিইগাতা ও শিজুওকা জেলাতেও বিস্তৃত হয়েছে। এই বিস্তৃতি প্রমাণ করে যে শিশু দারিদ্র্য জাপানে এখন আর লুকিয়ে রাখার মতো কোনো বিষয় নয়।
শিনজো আবের নেতৃত্বাধীন জাপানের সরকার দেশের অর্থনীতি সঠিক পথে এগিয়ে নেওয়া নিয়ে নিয়মিত বাগাড়ম্বর করে গেলেও অর্থনীতির সবকিছু যে ভালো নেই, জাপানের এই সাম্প্রতিক বাস্তবতা সেই ইঙ্গিত দেয়। এ বছরের শুরুতে পার্লামেন্টে দেওয়া এক ভাষণে আবে বলেছিলেন, ‘জাপানে দারিদ্র্য বজায় থাকার কোনো সুযোগ নেই...বৈশ্বিক মানের হিসাবে আমরা অবশ্যই হচ্ছি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একটি।’
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। ছবি: এএফপিবাস্তব অবস্থা কিন্তু এই বক্তব্যকে সমর্থন করছে না। এর কারণ হলো, সম্পদের বণ্টনব্যবস্থায় দেখা দেওয়া ত্রুটি। অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে গত প্রায় দুই দশক ধরে বিরাজমান ব্যবস্থাগুলোকে ভেঙে ফেলে নতুন যেসব নিয়মকানুন প্রবর্তন করা হচ্ছে, সেগুলোর কারণে ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার ফারাক বৃদ্ধি পেয়ে নতুন একশ্রেণির আবির্ভাবের সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। এই শ্রেণিটি সবদিক থেকেই বঞ্চিত। আর এ কারণে এদের পরিবারের শিশু সন্তানদের দেশের সার্বিক প্রাচুর্য সত্ত্বেও অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে।

তবে আশার দিকটি হলো, এই সমস্যা এখন আর চাপা পড়া অবস্থায় নেই। দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ—সবাই এখন এ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। ফলে, সরকার এই সমস্যা সমাধানের দিকে আরও বেশি নজর দেবে—সেই আশা অনেকেই করছেন।

- Get link
- X
- Other Apps
Comments