পুতিনের টার্গেট ইন্টারনেট!
- Get link
- X
- Other Apps

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজের দেশে শাসক হিসেবে একমেবাদ্বিতীয়ম। দিন দিন নিজের ক্ষমতার পরিধি তিনি বাড়িয়েই চলেছেন। এবার হাত দিয়েছেন ইন্টারনেটের দুনিয়ায়। অন্তর্জালে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সব আয়োজন শেষ করে এনেছেন পুতিন। এবার জাল গুটিয়ে আনার পালা। এই কাজ শেষ হলেই রুশ ভার্চ্যুয়াল জগৎ নিয়ন্ত্রণের ‘সুইচ’ চলে আসবে পুতিনের পকেটে।
বোকা বাক্স দিয়ে সাধারণ মানুষকে বোকা বানানোর দিন এখন আর নেই। ইন্টারনেট পুরো পৃথিবীকে একটি ছোট গণ্ডির মধ্যে এনে ফেলেছে। সেই ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ হাতের মুঠোয় নেওয়াও কঠিন। সেই কষ্টসাধ্য কাজটিই করতে চাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সাবেক সোভিয়েত আমলের অভিজ্ঞতা থেকে ভালোই শিখেছেন একসময়কার এই কেজিবি এজেন্ট। তিনি বুঝেছেন যে, জনগণকে যত কম জানানো যায় ততই মঙ্গল। এরা যত বেশি জানে, তত বেশি বোঝে! সুতরাং জনগণের জানা-বোঝার সুযোগ সীমিত করে দেওয়াই ক্ষমতা সংরক্ষণের উৎকৃষ্ট উপায়।

ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, রাশিয়ায় জাতীয় টেলিভিশনের একচেটিয়া আধিপত্যে ভাগ বসিয়েছে ইউটিউব। রাশিয়ার ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের ৮২ শতাংশই সংবাদ পেতে ইউটিউবে চোখ রাখছেন। রুশদের মধ্যে ইউটিউবে সংবাদ খোঁজার প্রবণতা বেশি। রাশিয়ায় পুতিনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে অন্যতম আলেক্সেই নাভালনি। তিনি খুব ভালো করেই জানেন, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেলে তাঁর খবরাখবর আসার আশা নেই। তাই দুটি ইউটিউব চ্যানেল খুলে তাতে নিজের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রচার করছেন নাভালনি। গত বছর এই দুটি ইউটিউব চ্যানেলের দর্শকসংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। প্রতি মাসে কমপক্ষে ২৫ লাখ সাবস্ক্রাইবার পান তিনি।
অর্থাৎ এটি স্পষ্ট যে, খবরের জন্য ইন্টারনেটভিত্তিক উৎসের প্রতি রুশদের নির্ভরতা ক্রমেই বাড়ছে। আর এতেই কপালের ভাঁজ বাড়ছে পুতিনের। ক্রেমলিন এখন সরকারবিরোধী প্রোপাগান্ডা থামাতে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের পথ খুঁজছে। লন্ডনের কিংস কলেজের শিক্ষক ও রুশ ইন্টারনেট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ গ্রেগরি আসমোলোভ বলেন, ‘ইন্টারনেটকে কীভাবে টিভি চ্যানেলে রূপান্তর করা যায়—সরকার এখন সেই চেষ্টা করছে।’ তিনি আরও বলেন, এর জন্য শুধু কঠোর নিয়মকানুন যথেষ্ট নয়। একই সঙ্গে ইন্টারনেট অবকাঠামো ও কনটেন্টের প্রবাহের ওপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে।
পুতিনের সরকার সেই পথেই হাঁটতে শুরু করেছে। সরকারবিরোধী কথাবার্তাকে ‘ফেক নিউজ’-এর তকমা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি রাশিয়ায় ফেক নিউজ প্রতিরোধে নতুন আইন পাস হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সেই আইনে স্বাক্ষরও করে দিয়েছেন। নতুন আইনের আওতায়, যে তথ্যকে সরকারের কাছে মিথ্যা বলে মনে হবে, তা নিষিদ্ধ করে দেওয়া যাবে। এ ছাড়া যে তথ্যকে জনশৃঙ্খলা লঙ্ঘনের কারণ বলে মনে করবে সরকার, সেটিও নিষিদ্ধ করা যাবে। এর শাস্তি হিসেবে ৪ লাখ রুবল (প্রায় ৬ হাজার ১০০ ডলার) পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ তুলে যেকোনো ওয়েবসাইট ব্লকও করে দিতে পারবে সরকার।
বিজনেস ইনসাইডার অবশ্য বলছে, যে দোষের শাস্তি নিশ্চিত করতে এই আইন পাস করা হয়েছে, সেই দোষে দুষ্ট রাশিয়াই! বিশ্বে যত ফেক নিউজ তৈরি হয়, তার একটি বড় অংশই আসে রাশিয়া থেকে। ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো এই অভিযোগ করেছে। অন্য সরকার ও অধিকার সংস্থাগুলোও রাশিয়ার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলেছে।

ব্লুমবার্গ বলছে, নতুন আইন ব্যবহার করে স্রেফ এক সুইচ টিপে পুরো রাশিয়ার তথ্যপ্রবাহ থমকে দিতে পারবেন পুতিন। এই নকশাতেই তৈরি করা হয়েছে ‘ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব’ শীর্ষক আইনটি। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আন্দ্রেই সোলদাতোভ বলেন, ‘কোনো বিদেশি হুমকি বা ফেসবুক-গুগলকে ঠেকাতে এই আইন করা হয়নি। ওই কাজ এখনই পারে রুশ সরকার। বেসামরিক বিক্ষোভের সময় কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় ইন্টারনেটের পুরো ট্রাফিক সিস্টেমই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এই আইনের আওতায়। ফলে সরকারবিরোধী প্রচার সহজেই শনাক্ত করে বন্ধ করা যাবে।’
চীনের পথ ধরছে রাশিয়া?
ইন্টারনেটের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ চীনের তৈরি। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবস্থা থেকে নিজেদের আলাদা করে ফেলে চীন। ওই ব্যবস্থাকে ‘গ্রেট ফায়ারওয়াল’ বলে অভিহিত করা হয়। এখনো ফেসবুক ঘাঁটি গাড়তে পারেনি চীনে। বৈশ্বিক ইন্টারনেটের জগৎ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন চীন।
ইন্টারনেটের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ চীনের তৈরি। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবস্থা থেকে নিজেদের আলাদা করে ফেলে চীন। ওই ব্যবস্থাকে ‘গ্রেট ফায়ারওয়াল’ বলে অভিহিত করা হয়। এখনো ফেসবুক ঘাঁটি গাড়তে পারেনি চীনে। বৈশ্বিক ইন্টারনেটের জগৎ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন চীন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের পথেই হাঁটতে চাইছে রাশিয়া। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন। চীন তো শুরু থেকেই কঠোর নিয়মকানুন আরোপ করে রেখেছে। আর রাশিয়া বৈশ্বিক ইন্টারনেটের দুনিয়ায় যুক্ত হয়েছে অনেক আগেই। ইন্টারনেটের বৈশ্বিক অবকাঠামোয় রাশিয়ার বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে। রাশিয়ায় সার্ভার স্থাপন করেছে গুগলের মতো টেক জায়ান্ট। তার চেয়ে বড় কথা, ইউটিউবের মতো জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে রুশরা। সেই অভ্যাস সমূলে উৎপাটন করা কঠিন। এতে করে নতুন করে জনবিক্ষোভ সৃষ্টি হতে পারে।
তবে হ্যাঁ, বন্ধ করার চেয়ে, ইচ্ছে হলেই বন্ধ করতে পারি—এমন বার্তা বেশি কাজে দেয়। এতে করে ফেসবুক, গুগলের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানও নিজেদের গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়। ফেক নিউজ ঠেকাতে নিপীড়নমূলক আইন পাস করে সেটিই করতে চাইছেন পুতিন। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়ার অধ্যাপক রংবিন হান বলেন, ‘চীনের দেখানো পথেই যাচ্ছে রাশিয়া। রাজনৈতিক মতভিন্নতা উচ্ছেদ করতে পুরো ইন্টারনেট ব্যবস্থা বন্ধ করার দরকার পড়ে না। এর চেয়ে অনলাইন কনটেন্টগুলো ফিল্টার করলেই চলে। সেটিই চমৎকার উপায়।’
ইন্টারনেট পুতিনের হবে?
গত কয়েক বছর ধরেই ফেসবুক, গুগল, টুইটার, লিংকডইনসহ বিভিন্ন বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে দৌড়ের ওপর রেখেছে ক্রেমলিন। অনলাইনে বিভিন্ন বিষয়ে সেন্সর করতে চাইছে পুতিনের সরকার। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাশিয়ায় সার্ভার স্থাপনের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরেই ফেসবুক, গুগল, টুইটার, লিংকডইনসহ বিভিন্ন বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে দৌড়ের ওপর রেখেছে ক্রেমলিন। অনলাইনে বিভিন্ন বিষয়ে সেন্সর করতে চাইছে পুতিনের সরকার। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাশিয়ায় সার্ভার স্থাপনের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।

ওদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ৬৬ বছর বয়সী প্রেসিডেন্টের ওপর রুশ জনগণের আস্থা কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে, ঠেকেছে ৩৩ দশমিক ৪ শতাংশে। ২০০৬ সালের পর এবারই তা সর্বনিম্ন। অথচ ২০১৫ সালের জুলাইয়ে তা পৌঁছেছিল ৭১ শতাংশে।
অর্থাৎ, লক্ষণ খুব একটা ভালো নয়। দেশের ইন্টারনেট দুনিয়ায় থাবা বসিয়ে কত দিন স্বস্তিতে থাকতে পারেন পুতিন, তাই এখন দেখার বিষয়।

- Get link
- X
- Other Apps
Comments