‘হারকিউলিস’ একদিন বাংলাদেশেও ছিলেন!
- Get link
- X
- Other Apps

ভিনদেশে থাকলে দেশে ফেরার সাধ থাকে সবারই। কলকাতা আইচের জন্য কি ভিনদেশ ছিল? বোধ হয় না। নইলে আলিপুর জেল থেকে বের হওয়ার পর ফিরতে পারতেন বাংলাদেশে। তা না করে জীবন কাটিয়ে দিলেন ওখানেই। ওখানেই গড়েছেন তাঁর শরীর নামের ‘মন্দির’। ওই ‘মন্দির’ গড়েই পেয়েছেন যত নাম-যশ-খ্যাতি। শুধু তার ভিত্তিটুকু গড়ে দিয়েছে বাংলাদেশের আলো-বাতাস-মাটি। কিন্তু জন্মভূমি তো! মনোহর তাই ফিরতে চাইতেন কুমিল্লার ধামতি গ্রামে। মরার আগে অন্তত একবার।

কিন্তু মনোহরের মনোলোভা জীবনকে তাঁর বুকের ছাতির মতোই এটুকু ফ্রেমে বাঁধা যায় না। বাঙালি তাঁকে মনে রেখেছে বডিবিল্ডিংয়ে নিজেদের ‘মিস্টার ইউনিভার্স’ হিসেবে। একদিন বাঙালিরও এক ‘পকেট হারকিউলিস’ ছিল! ইউনিভার্স হওয়ার অনন্য উচ্চতায় বাঙালিকে তিনি একাই কিংবা সবার আগে পৌঁছে দেননি। মনোহরকে আলাদা করে মনে রাখার কারণ তাঁর জীবনপ্রণালি, প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে নিজের লক্ষ্য ছুঁয়ে আজীবন একই রকম থাকার জন্য।

মনোহর নিজেও তখন জানতেন না। রাস্তাঘাটে কসরত দেখানোর মাধ্যমে একদিন তাঁর পরিচয় ঘটল উপমহাদেশের প্রবাদপ্রতিম জাদুকর পিসি সরকারের সঙ্গে। সরকার বললেন, ‘আমার সঙ্গে যোগ দাও।’ মনোহর সায় দেওয়ার পর দুজন মিলে ‘ফিজিক অ্যান্ড ম্যাজিক’ নামের পথ-সার্কাসে যে জুটি গড়েছিলেন, তা তখনকার মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। প্রদর্শনীতে মনোহর লোহার দণ্ড বাঁকাতেন দাঁত ও কাঁধ দিয়ে। তরবারির মাথায় পেট দিয়ে ভর করে দেখিয়েছেন শরীরের ভারসাম্য। ১৫০০ পাতার বই আড়াআড়ি ছিঁড়েছেন এক টানে। আর ২০০ কেজির বেশি ওজন টেনেছেন অবলীলায়।
ভারতবর্ষের প্রবাদপ্রতিম ব্যায়ামবীর বিষ্ণু ঘোষের আখড়ায় মনোহরের শরীরচর্চার হাতেখড়ি। চল্লিশের দশকে মতান্তরে ১৯৪২ সালে তিনি যোগ দেন ব্রিটেনের রাজকীয় বিমানবাহিনীতে। উচ্চতা অনেক কম হলেও শরীরচর্চার শিক্ষক হিসেবে তাঁকে নেওয়া হয়। এখান থেকেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে গেল। বাঙালি তখন ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে সরগরম। এক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তার মুখে বাঙালির অপমান সহ্য করতে না পেরে কষে চড় মেরেছিলেন মনোহর।

কিন্তু ছাড়া পেয়ে যান চার বছরেই। জেলবাসের সেই সময়ে মনোহর শরীরচর্চাকে জীবনের ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে নিয়ে নেন। ডন-বৈঠক আর কসরত করতে গিয়ে বাঁকিয়ে ফেলেছিলেন জেলের লোহার শিকও। কারা-কর্মকর্তারা মনোহরের শরীরচর্চার প্রতি আত্মনিবেদন দেখে তাঁকে আলাদা করে পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করতেন। লাহোর, পেশোয়ার হয়ে আলিপুর জেল থেকে মনোহর ছাড়া পেলেন স্বাধীন ভারতের মাটিতে।
শরীরচর্চার নেশা তখন মনোহরের মনে পুরোপুরি জেঁকে বসেছে। ৩৫ বছরের ওপাশে গিয়ে মন দিলেন পেশাদার শরীরচর্চায়। কিন্তু বাতাস খেয়ে তো আর শরীরচর্চা হয় না! ডাবের ঝুলি নিয়ে বসে গেলেন শিয়ালদহ স্টেশনে। এভাবে ১৯৫০ সালে জিতলেন ‘মিস্টার হারকিউলিস’ প্রতিযোগিতা। ব্যস, বাঙালি পেয়ে গেল তাদের হারকিউলিসকে। কিন্তু মনোহর যেতে চেয়েছিলেন আরও উঁচুতে, আর তাই পরের বছর অংশ নিলেন ‘মিস্টার ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতায়। পারলেন না মনতোষ রায়ের জন্য।

খেটেখুটে টানা একটি বছর নিজেকে প্রস্তুত করে ১৯৫২ সালে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতার শরীরের বাইসেপ তখন ৪৬ সেমি, বুকের মাপ স্ফীত অবস্থায় ১২০ সেমি, হাতের প্রস্থ ৩৬ সেমি আর কবজি সাড়ে ১৬ সেমি আর কোমর মাত্র ২৩ ইঞ্চি। আদর্শ ‘ভি’ গঠনের এই শরীর নিয়ে মনোহরের মিস্টার ইউনিভার্স হওয়া সেবার আর কেউ ঠেকাতে পারেনি। পরের গল্পটা এই উপমহাদেশের মোটামুটি বাকি সব কিংবদন্তির মতোই। ঈর্ষণীয় খ্যাতির গগনে বিরাজ করলেন মনোহর। আর শেষ বয়সে ভুগেছেন আর্থিক টানাটানিতে। তাঁর সন্তানেরা সাধ্যমতো চেষ্টাও করেছেন বাবাকে ভালো রাখার। সেটি পুরোপুরি হয়ে না উঠলেও মনোহরের কোনো আক্ষেপ ছিল না। পরিবারের ভাষায়, ‘জীবন যেখানে যেমন’—এটাই ছিল মনোহরের দর্শন।

এখনকার শরীরচর্চায় উচ্চমাত্রার প্রোটিন পিল আর ডাম্বেল-নির্ভর জিমনেসিয়ামের পাশে মনোহরের খাদ্যতালিকা রাখুন—পান্তা ভাত, ডাল, শাকসবজি আর মাছের মাথা। মাছের মাথায় নাকি গ্রোথ হরমোন থাকে, মনোহর বলতেন। আধুনিক জিমে গিয়ে কষে ওয়েটলিফটিং একদম পছন্দ করতেন না। সাবেকি কায়দায় ডন-বৈঠকে ভরসা রেখেই বাঙালির মাথায় বিশ্বসেরার মুকুট পরিয়েছিলেন মনোহর। বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করার দিন (মিস্টার ইউনিভার্স জয়) আর তাঁর জন্মও একই দিনে। আজ এই দিনে!
অথচ এই মানুষটা মরার আগে একবার জন্মভূমিতে ফিরতে পারলেন না।

- Get link
- X
- Other Apps
Comments