বান্দরবানে পাথরখেকোদের তত্পরতা থামছেই না
বান্দরবানের লামা উপজেলার বনপুর সড়কে পাথরভর্তি ট্রাক।
লামা উপজেলার বনপুরে অবৈধ পাথরবোঝাই ৯টি ট্রাক আটক নিয়ে প্রশাসন ও বিজিবির মধ্যে নানা টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। এর পরও বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় পাথর আহরণ বন্ধ হয়নি। নতুন কৌশল হিসেবে পুরনো নিলামের কাগজ দিয়ে পাথরখেকোরা প্রকাশ্য দিবালোকে স্থানীয়ভাবে আহরিত ঝিরি-ছড়ার পাথর পাচার করছে। প্রতিবেদন : মনু ইসলাম, বান্দরবান
বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার বগালেক এলাকা, লামা উপজেলার বনপুর-ফাঁসিয়াখালিসহ দুর্গম কয়েকটি এলাকা, নাইক্ষ্যংছড়ির সোনাইছড়ি এবং আলীকদম-থানচি সড়ক সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পাথর আহরণ করা হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, পাথর পাচারকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও জনগণ পাত্তা পাচ্ছেন না।
সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয় পাথর
ব্যবহার না করার নির্দেশ দিয়েছেন। এর পরও সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহারের নাম দিয়েই এসব স্থানীয় পাথর উত্তোলন ও পাচার করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত বান্দরবান জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মার্চ মাসের সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয় পাথর
ব্যবহার না করার নির্দেশ দেন।
সভায় প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এলজিইডির ল্যাব টেস্টে স্থানীয়ভাবে উত্তোলিত পাথর নির্মাণ কাজে ব্যবহারের উপযোগী নয় প্রতীয়মান হয়েছে। এ অবস্থায় নিম্নমানের স্থানীয় পাথর উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করা হলে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেকোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।’
প্রতিমন্ত্রীর এই কড়া নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও সড়ক ও সেতু-কালভার্ট নির্মাণ কাজে বেপরোয়াভাবে অপরিপক্ব ও নিম্নমানের স্থানীয় পাথর ব্যবহার করা হচ্ছে।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, দুর্গম এলাকা হওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে আলীকদম-থানচি সড়কের পাশে পাথর উত্তোলনের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ছড়া-ঝিরি ও পাহাড়ের পাদদেশ থেকে সংগৃহীত পাথর আলীকদম-থানচি সড়কের পাশে মজুদ করে মেশিন ব্যবহার করে ভাঙা হচ্ছে। এরপর লামা সংযোগ সড়ক হয়ে পাথরের খোয়াগুলো (স্টোন চিপ) বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চলে যাচ্ছে।
এদিকে লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী এলাকা থেকে পাথর উত্তোলনের মাত্রাও কমছে না।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির ৩১ ব্যাটালিয়নের জওয়ানরা ৩ মার্চ লামা উপজেলার বনপুর এলাকা থেকে পাথরবোঝাই ৯টি ট্রাক আটক করেন। এই পাথর আটক করার কর্তৃত্ব নিয়ে বন বিভাগ, উপজেলা প্রশাসন এবং বিজিবির মধ্যে ৪ দিন রশি টানাটানি হয়েছে। এ ঘটনার পর কয়েকদিন পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকলেও আবারও পাথরখেকোদের আনাগোনা লক্ষ করা যাচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, একটি প্রভাবশালী চক্র এই পাথর পাচারের সাথে জড়িত থাকায় পাথর পাচার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। নাইক্ষ্যংছড়িস্থ ৩১ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আনোয়ারুল আজিম জানান, নাইক্ষ্যংছড়ি জোনের আওতাধীন ত্রিশডেবা ক্যাম্পের জওয়ানরা পাথর আটকের পরপরই বিষয়টি লামা উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনা তদন্তের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একই উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ সায়েদ ইকবালকে ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব প্রদান করেন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আনোয়ারুল আজিম জানান, ঘটনার পরদিন ভূমি কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে এসে পাথর জব্দ দেখিয়ে ট্রাকগুলো ছেড়ে দিতে চাইলে বিজিবি জওয়ানরা বাধা দেন। এ অবস্থায়
বনপুর-রামগতি সড়কে পাথরভর্তি ট্রাক ফেলে রেখে পাথর ব্যবসায়ী এবং চালকরা পালিয়ে যায়।
ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান জাকের হোসেন মজুমদার জানান, ওই এলাকার কোনো ঝিরি বা ছড়াতে বর্তমানে কোনো ভাসমান পাথর নেই। এ কারণে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট গত ৬/৭ বছর ধরে নদী-ছড়ার মাটি ও পাহাড় খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করছে।
তিনি অভিযোগ করেন, অভিযোগ করা হলেও প্রশাসন তাঁদের পাত্তা দিচ্ছে না। স্থানীয়রা জানান, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ১, ২, ৩ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ছমুখাল, পাইকঝিরি, ওয়াক্রাপাড়া, খ্রিস্টানপাড়া, মরাঝিরি, চচাইপাড়া, কেরানীঝিরি, কইতরেরঝিরি, বুদুমঝিরি, চিনিরঝিরি, গয়ালমারা, বালস্ট কারবারিপাড়া ঝিরি, জোয়াকি পাড়া, বাঁকখালীঝিরি, হরিণঝিরি, রবার্ট কারবারি পাড়াঝিরি, বালুরঝিরি, আলিক্ষ্যংঝিরি, কাঁঠালছড়া ও বদুরঝিরি হতে প্রতিরাতে ডজন ডজন গাড়িতে করে অবৈধভাবে উত্তোলিত পাথর পাচার হয়ে যাচ্ছে।
পাথরবোঝাই ভারী ট্রাক চলাচলের কারণে রাস্তাঘাট ও ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয়ে ইউনিয়নের বিপুলসংখ্যক বাসিন্দাকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর এক বিশেষ অভিযান চালিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সোনাইছড়ি এলাকায় অননুমোদিত বেশ কয়েকটি পাথরের কোয়ারির সন্ধান পেয়েছেন। এসব কোয়ারি প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিদের হওয়ায় প্রশাসন তেমন কোনো জোরালো ভূমিকা নিচ্ছে না।
তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার অফিসের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশরাফ জানান,
অভিযান চলাকালে সোনাইছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাহান মারমার মালিকানাধীন একটি পাথর কোয়ারিতে বেআইনিভাবে বিপুল পরিমাণ পাথর মজুদ এবং পাচারের প্রমাণ মিলেছে। তবে পাথর উত্তোলন এবং উত্তোলিত পাথরের ট্রানজিট পারমিট (টিপি) আছে কিনা তাত্ক্ষণিকভাবে তা জানা যায়নি।
তিনি জানান, অভিযুক্ত সোনাইছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান বাহান মারমার কাছে পাথর উত্তোলনের অনুমতিপত্র চাওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হলে পরিবেশ আইনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয়রা জানান, সোনাইছড়ি ইউনিয়নের রেজু খালের হরিনমারা, ক্যংদং, মহেশকুম ঝিরিসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পাথর উত্তোলন ও ভাঙনের যন্ত্র ব্যবহার করে গত দু’মাস যাবত পাথর ভাঙছেন।
এসব পাথর রাতের আঁধারে ট্রাক (ডাম্পার) যোগে ঘোনারপাড়া-বৈদ্যছড়া সড়ক হয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বান্দরবান জেলা প্রশাসন জানায়, পাথর উত্তোলনের জন্যে নতুনভাবে কাউকে পারমিট দেওয়া হচ্ছে না।
একই তথ্য পাওয়া গেছে, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস এম সারোয়ার কামাল এবং লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার খিন ওয়ান নু। তারা জানান, সরকারি নিলামে পাওয়া পারমিটের ভিত্তিতে কিছু কিছু পাথর পরিবহন করা হচ্ছে।
তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নিলামের মাধ্যমে ক্রয়কৃত পাথর পরিবহনের জন্য ইস্যু করা ট্রানজিট পারমিট দিয়ে মাসের পর মাস পাথর পাচার হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন বিভাগীয় একজন কর্মকর্তা জানান, বান্দরবানে পাথর পাচারের নয়া কৌশলের নাম ‘নিলাম’।
তিনি জানান, একটি নির্দিষ্ট এলাকার নিলামের পারমিট দিয়ে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মাসের পর মাস বিনা বাধায় লাখ লাখ ঘনফুট পাথর পাচার করা হচ্ছে।
Comments