ভূমি ও পুলিশ প্রশাসন ছাড়তে চায় না সরকার
- Get link
- X
- Other Apps
আইন অনুযায়ী রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের কাছে সেখানকার ভূমি প্রশাসন ও জেলা পুলিশ হস্তান্তর করার কথা। পার্বত্য চুক্তি সইয়ের পর ১৯৯৮ সালে তিনটি জেলা পরিষদের জন্য প্রায় অভিন্ন তিনটি আইনে (সংশোধিত) এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি বিভাগ এখনো সরকারের নিয়ন্ত্রণেই রয়ে গেছে। ফলে পাহাড়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ এবং ভূমির জটিলতা নিরসনে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।
পাহাড়ি সমাজের নেতারা বলেন, অন্য এলাকা থেকে আসা পুলিশ পার্বত্য এলাকার মানুষের স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কে জানে না। পরিষদের আইন অনুযায়ী, জেলা পুলিশ বাহিনীতে পাহাড়ের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা আছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তিন পার্বত্য এলাকায় পুলিশ বাহিনীতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষ নিয়োগ পেলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হতো। পুলিশের প্রতিও স্থানীয় বাসিন্দাদের আস্থা বাড়ত।
বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর জেলায় হাজার হাজার একর ভূমি বহিরাগত ব্যক্তিরা দখল করছে। পাহাড়িদের পাশাপাশি অনেক বাঙালিও ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। পার্বত্য চুক্তির আলোকে ভূমির তদারকির দায়িত্ব পরিষদের কাছে থাকলে এটি ঘটত না। ওই দুটি বিভাগের বাইরেও পার্বত্য এলাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বন বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ হস্তান্তর হয়নি বলে জানান তিনি।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর দাবি করেন, আগের চেয়ে জেলা পরিষদগুলোর সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পরিষদের কাছে বিভাগ হস্তান্তরের পদ্ধতিগত ত্রুটি দূর করার জন্য বেশ কয়েকবার আন্তমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে। পুলিশ ও ভূমি প্রশাসন পরিষদের কাছে হস্তান্তরের বিষয়টি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ক্রমান্বয়ে এসব হবে। কাজ করতে গিয়ে কিছু সমস্যা বের হচ্ছে, সেগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দ পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরাসরি জেলা পরিষদগুলো যাতে পায়, তা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। অন্য মন্ত্রণালয়ও বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছে। আর পরিষদ আইনের বিধিমালা তৈরির কাজ আইন মন্ত্রণালয়ে চলছে।
জেলা পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ (প্রতিষ্ঠান বা কর্মপরিষদ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে আইনে) হস্তান্তরের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে জেলা পরিষদ আইনের ২৩-এর ‘খ’ ধারায়। আইনে জেলা পরিষদের ৩৩টি কাজ (আইনশৃঙ্খলার উন্নতি সাধন, প্রথা অনুসারে সামাজিক বিরোধ মেটানো, শিক্ষার প্রসার, কৃষির উন্নয়ন, বন সংরক্ষণ, সমাজসেবা ইত্যাদি) নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। কিন্তু সরকারের কতটি বিভাগ হস্তান্তর করা হবে, তা ‘খ’ ধারায় বলা হয়নি।
পরিষদ আইনের ৬২ ধারা অনুযায়ী, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর (উপপরিদর্শক) ও এর নিচের স্তরের সব সদস্য প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরিষদের মাধ্যমে নিযুক্ত হবে। সেখানকার পুলিশের সদস্যদের (উপপরিদর্শক থেকে নিচের পদ পর্যন্ত) বদলি এবং তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতাও থাকবে সংশ্লিষ্ট পরিষদের কাছে। অবশ্য এসব কাজে পুলিশ প্রবিধান মেনে চলতে হবে। এ ছাড়া জেলা পুলিশের সব স্তরের কর্মকর্তা ও সদস্যরা তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সংশ্লিষ্ট পরিষদের কাছে দায়ী থাকবেন। একই আইনের ৬৩ ধারা অনুযায়ী, জেলায় কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে এর তথ্য পরিষদের চেয়ারম্যানকে জানাতে হবে। আবার আইনের ৬৪-৬৫ ধারা অনুযায়ী, ভূমি প্রশাসনের তদারকির দায়িত্বও পরিষদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
ভূমি ও পুলিশ জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর না করার পেছনে সরকারের সদিচ্ছার অভাব, কোনো কোনো মহলের বিরোধিতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দায়ী করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ বিভাগ হস্তান্তরের জন্য রাঙামাটিতে কয়েকবার সভা হয়েছিল। এ নিয়ে আলোচনা শুরু হলেই হরতাল-অবরোধের ডাক দেয় একটি মহল। তাদের ইন্ধন দেয় প্রভাবশালী কেউ কেউ। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন না হওয়াসহ বেশ কিছু কারণে জেলা পরিষদ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছে।
একজন চেয়ারম্যান এবং ৩৩ জন সদস্য নিয়ে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত। এর মধ্যে ২০ জন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সদস্য, ১০ জন অ-উপজাতীয় সদস্য এবং সংরক্ষিত নারী সদস্য তিনজন (যাঁদের একজন অ-উপজাতি নারী)। পরিষদের মেয়াদ পাঁচ বছর। খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান জেলা পরিষদের মেয়াদ এবং মোট সদস্য সংখ্যাও ৩৩ জন (সংরক্ষিত নারী সদস্যসহ)। তবে এই দুই জেলায় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে অ-উপজাতি এবং পাহাড়ি সদস্যদের সংখ্যায় সামান্য তারতম্য রয়েছে।
অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে জেলা পরিষদ পরিচালনা করায় হস্তান্তরিত বিভাগ ও দপ্তরগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন রাঙামাটির চাকমা সার্কেল প্রধান রাজা দেবাশীষ রায়। তিনি বলেন, জনগণের চাহিদার মাত্র ৪০ শতাংশ দক্ষতা দেখাতে পারছে এসব পরিষদ। তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পৃথক ভোটার তালিকা করে দ্রুত পরিষদের নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
বিভাগ হস্তান্তরে পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে কাজে সমস্যা হয় বলে জানান রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা। তিনি বলেন, জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত বিভাগগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান করে পরিষদ। হস্তান্তরিত বিভাগের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রয়েছে তাদের কাছে। কিন্তু দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পরিষদের নেই। কর্মকর্তারা বেতন-ভাতা নেন জেলা পরিষদ থেকে আর কাজ করেন মন্ত্রণালয়ের। জেলাভিত্তিক বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও জেলা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। ফলে জেলা পরিষদের কাছে কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করতে হয় না।
বৃষ কেতু চাকমা বলেন, জেলা পরিষদ পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত থোক বরাদ্দ দিয়ে হস্তান্তরিত বা ন্যস্ত বিভাগগুলোর স্থানীয় বাস্তবতা ও চাহিদার নিরিখে ছোট আকারের উন্নয়নকাজ করে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পভিত্তিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে তেমন কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না। সমতলের সঙ্গে পাহাড়ের উন্নয়নে সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য জেলা পরিষদ গঠন করা হলেও সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জন করা যাচ্ছে না।
পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে জেলা পরিষদগুলোয় বছরে গড়ে ৪৫ থেকে ৪৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। হস্তান্তরিত বিভাগগুলোয় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ পরিষদের মাধ্যমে দেওয়া দূরের কথা, কত টাকা বরাদ্দ হচ্ছে, তা-ও জানানো হয় না।
এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান থানজামা লুসাই বলেন, হস্তান্তরিত বিভাগের কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অসম সক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে হয় পরিষদকে। এর ফলে উন্নয়ন পকিল্পনা ও নীতিনির্ধারণে মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে পরিষদের সমন্বয় হচ্ছে না।
অবশ্য জেলা পরিষদের কারণে পাহাড়ের প্রান্তিক মানুষ ধীরে ধীরে উপকৃত হচ্ছে বলে জানান খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সদস্য আবদুল জব্বার। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের শ্রেণিকক্ষ সম্প্রসারণ, ছোট ছোট সড়ক উন্নয়নে অনেক কাজ হচ্ছে। তবে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হস্তান্তরিত বিভাগগুলোর সমন্বয় না থাকায় বড় কোনো প্রকল্প নেওয়া সম্ভব হয় না।
বিভাগ হস্তান্তরে পদ্ধতিগত ত্রুটি এবং মন্ত্রণালয়ের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির চেয়েও জেলা পরিষদ আইনের বিধিমালা না হওয়াও একটি সমস্যা বলে মনে করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান। তিনি বলেন, তিনটি জেলা পরিষদে দুই দশকের বেশি সময় ধরে নির্বাচন হচ্ছে না। যে দলের সরকার ক্ষমতায় আসে, সেই দলের নেতা-কর্মীদের চেয়ারম্যান ও সদস্য করে পরিষদে বসিয়ে দেওয়া হয়। এতে পরিষদগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা গড়ে উঠছে না।
১৯৮৯ সালে পার্বত্য জেলা পরিষদ স্থাপনের সময় সেনাবাহিনীর বান্দরবানের ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার (অব.) শাখাওয়াত হোসেন। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার যতটুকু মনে পড়ে ওই সময় পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরযোগ্য ২০ থেকে ২২টি বিষয় ছিল। ভূমি, স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এর অংশ ছিল। তখন বলা হয়েছিল, এ গুলো জেলা পরিষদের কাছে না থাকলে তারা সঠিক ও স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। নির্দিষ্ট সময় পর পর জেলা পরিষদের নির্বাচনও হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো জেলা পরিষদের হাতে অনেক দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। এটা দুঃখজনক।
সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার মনে করেন, সব জটিলতা অতিক্রম করে জেলা পরিষদের হাতে এই দায়িত্বগুলো বুঝিয়ে দিতে হবে। না হলে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না।
বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর জেলায় হাজার হাজার একর ভূমি বহিরাগত ব্যক্তিরা দখল করছে। পাহাড়িদের পাশাপাশি অনেক বাঙালিও ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। পার্বত্য চুক্তির আলোকে ভূমির তদারকির দায়িত্ব পরিষদের কাছে থাকলে এটি ঘটত না। ওই দুটি বিভাগের বাইরেও পার্বত্য এলাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বন বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ হস্তান্তর হয়নি বলে জানান তিনি।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর দাবি করেন, আগের চেয়ে জেলা পরিষদগুলোর সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পরিষদের কাছে বিভাগ হস্তান্তরের পদ্ধতিগত ত্রুটি দূর করার জন্য বেশ কয়েকবার আন্তমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে। পুলিশ ও ভূমি প্রশাসন পরিষদের কাছে হস্তান্তরের বিষয়টি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ক্রমান্বয়ে এসব হবে। কাজ করতে গিয়ে কিছু সমস্যা বের হচ্ছে, সেগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দ পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরাসরি জেলা পরিষদগুলো যাতে পায়, তা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। অন্য মন্ত্রণালয়ও বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছে। আর পরিষদ আইনের বিধিমালা তৈরির কাজ আইন মন্ত্রণালয়ে চলছে।
জেলা পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ (প্রতিষ্ঠান বা কর্মপরিষদ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে আইনে) হস্তান্তরের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে জেলা পরিষদ আইনের ২৩-এর ‘খ’ ধারায়। আইনে জেলা পরিষদের ৩৩টি কাজ (আইনশৃঙ্খলার উন্নতি সাধন, প্রথা অনুসারে সামাজিক বিরোধ মেটানো, শিক্ষার প্রসার, কৃষির উন্নয়ন, বন সংরক্ষণ, সমাজসেবা ইত্যাদি) নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। কিন্তু সরকারের কতটি বিভাগ হস্তান্তর করা হবে, তা ‘খ’ ধারায় বলা হয়নি।
পরিষদ আইনের ৬২ ধারা অনুযায়ী, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর (উপপরিদর্শক) ও এর নিচের স্তরের সব সদস্য প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরিষদের মাধ্যমে নিযুক্ত হবে। সেখানকার পুলিশের সদস্যদের (উপপরিদর্শক থেকে নিচের পদ পর্যন্ত) বদলি এবং তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতাও থাকবে সংশ্লিষ্ট পরিষদের কাছে। অবশ্য এসব কাজে পুলিশ প্রবিধান মেনে চলতে হবে। এ ছাড়া জেলা পুলিশের সব স্তরের কর্মকর্তা ও সদস্যরা তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সংশ্লিষ্ট পরিষদের কাছে দায়ী থাকবেন। একই আইনের ৬৩ ধারা অনুযায়ী, জেলায় কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে এর তথ্য পরিষদের চেয়ারম্যানকে জানাতে হবে। আবার আইনের ৬৪-৬৫ ধারা অনুযায়ী, ভূমি প্রশাসনের তদারকির দায়িত্বও পরিষদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
ভূমি ও পুলিশ জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর না করার পেছনে সরকারের সদিচ্ছার অভাব, কোনো কোনো মহলের বিরোধিতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দায়ী করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ বিভাগ হস্তান্তরের জন্য রাঙামাটিতে কয়েকবার সভা হয়েছিল। এ নিয়ে আলোচনা শুরু হলেই হরতাল-অবরোধের ডাক দেয় একটি মহল। তাদের ইন্ধন দেয় প্রভাবশালী কেউ কেউ। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন না হওয়াসহ বেশ কিছু কারণে জেলা পরিষদ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছে।
একজন চেয়ারম্যান এবং ৩৩ জন সদস্য নিয়ে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত। এর মধ্যে ২০ জন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সদস্য, ১০ জন অ-উপজাতীয় সদস্য এবং সংরক্ষিত নারী সদস্য তিনজন (যাঁদের একজন অ-উপজাতি নারী)। পরিষদের মেয়াদ পাঁচ বছর। খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান জেলা পরিষদের মেয়াদ এবং মোট সদস্য সংখ্যাও ৩৩ জন (সংরক্ষিত নারী সদস্যসহ)। তবে এই দুই জেলায় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে অ-উপজাতি এবং পাহাড়ি সদস্যদের সংখ্যায় সামান্য তারতম্য রয়েছে।
অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে জেলা পরিষদ পরিচালনা করায় হস্তান্তরিত বিভাগ ও দপ্তরগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন রাঙামাটির চাকমা সার্কেল প্রধান রাজা দেবাশীষ রায়। তিনি বলেন, জনগণের চাহিদার মাত্র ৪০ শতাংশ দক্ষতা দেখাতে পারছে এসব পরিষদ। তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পৃথক ভোটার তালিকা করে দ্রুত পরিষদের নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
বিভাগ হস্তান্তরে পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে কাজে সমস্যা হয় বলে জানান রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা। তিনি বলেন, জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত বিভাগগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান করে পরিষদ। হস্তান্তরিত বিভাগের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রয়েছে তাদের কাছে। কিন্তু দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পরিষদের নেই। কর্মকর্তারা বেতন-ভাতা নেন জেলা পরিষদ থেকে আর কাজ করেন মন্ত্রণালয়ের। জেলাভিত্তিক বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও জেলা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। ফলে জেলা পরিষদের কাছে কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করতে হয় না।
বৃষ কেতু চাকমা বলেন, জেলা পরিষদ পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত থোক বরাদ্দ দিয়ে হস্তান্তরিত বা ন্যস্ত বিভাগগুলোর স্থানীয় বাস্তবতা ও চাহিদার নিরিখে ছোট আকারের উন্নয়নকাজ করে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পভিত্তিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে তেমন কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না। সমতলের সঙ্গে পাহাড়ের উন্নয়নে সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য জেলা পরিষদ গঠন করা হলেও সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জন করা যাচ্ছে না।
পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে জেলা পরিষদগুলোয় বছরে গড়ে ৪৫ থেকে ৪৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। হস্তান্তরিত বিভাগগুলোয় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ পরিষদের মাধ্যমে দেওয়া দূরের কথা, কত টাকা বরাদ্দ হচ্ছে, তা-ও জানানো হয় না।
এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান থানজামা লুসাই বলেন, হস্তান্তরিত বিভাগের কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অসম সক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে হয় পরিষদকে। এর ফলে উন্নয়ন পকিল্পনা ও নীতিনির্ধারণে মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে পরিষদের সমন্বয় হচ্ছে না।
অবশ্য জেলা পরিষদের কারণে পাহাড়ের প্রান্তিক মানুষ ধীরে ধীরে উপকৃত হচ্ছে বলে জানান খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সদস্য আবদুল জব্বার। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের শ্রেণিকক্ষ সম্প্রসারণ, ছোট ছোট সড়ক উন্নয়নে অনেক কাজ হচ্ছে। তবে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হস্তান্তরিত বিভাগগুলোর সমন্বয় না থাকায় বড় কোনো প্রকল্প নেওয়া সম্ভব হয় না।
বিভাগ হস্তান্তরে পদ্ধতিগত ত্রুটি এবং মন্ত্রণালয়ের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির চেয়েও জেলা পরিষদ আইনের বিধিমালা না হওয়াও একটি সমস্যা বলে মনে করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান। তিনি বলেন, তিনটি জেলা পরিষদে দুই দশকের বেশি সময় ধরে নির্বাচন হচ্ছে না। যে দলের সরকার ক্ষমতায় আসে, সেই দলের নেতা-কর্মীদের চেয়ারম্যান ও সদস্য করে পরিষদে বসিয়ে দেওয়া হয়। এতে পরিষদগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা গড়ে উঠছে না।
১৯৮৯ সালে পার্বত্য জেলা পরিষদ স্থাপনের সময় সেনাবাহিনীর বান্দরবানের ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার (অব.) শাখাওয়াত হোসেন। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার যতটুকু মনে পড়ে ওই সময় পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরযোগ্য ২০ থেকে ২২টি বিষয় ছিল। ভূমি, স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এর অংশ ছিল। তখন বলা হয়েছিল, এ গুলো জেলা পরিষদের কাছে না থাকলে তারা সঠিক ও স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। নির্দিষ্ট সময় পর পর জেলা পরিষদের নির্বাচনও হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো জেলা পরিষদের হাতে অনেক দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। এটা দুঃখজনক।
সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার মনে করেন, সব জটিলতা অতিক্রম করে জেলা পরিষদের হাতে এই দায়িত্বগুলো বুঝিয়ে দিতে হবে। না হলে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না।
- Get link
- X
- Other Apps
Comments