রাঙামাটির ফুরমোন নিচপাড়া অভাব তাড়িয়ে সংসারের হাল ধরেছেন নারীরা/১৭ নভেম্বর ২০১৬, ০০:৫৮
রাঙামাটির সাপছড়ির ফুরমোন নিচপাড়ার বাসিন্দা সুমিতা চাকমা (৩৫)। বছর দুয়েক আগেও সংসারে ছিল টানাটানি। স্বামী প্রিয়ময় চাকমার (৪০) দিনমজুরির টাকায় কোনো রকমে দিন পার করছিলেন। তখন তিনবেলা খাবার জোটাতে হিমশিম খেতে হতো তাঁকে। তার ওপর এক ছেলে ও এক মেয়ের ভরণপোষণ। শেষে অভাবের কাছে পরাস্ত না হয়ে অভাব দূর করার সংকল্প করলেন। এরপর নিজের চাহিদার পাশাপাশি জুম ও বনে বাড়তি সবজির চাষ করতে থাকেন। এই বাড়তি সবজি বাজারে বিক্রি করে বছর খানেকের মধ্যে অভাব তাড়ালেন তিনি।
শুধু সুমিতা নন, একইভাবে সংসারে সচ্ছলতা আনতে সবজি চাষকেই বেছে নিয়েছেন এই পাড়ার আরও ১১ পরিবারের নারীরা। রাঙামাটি শহর থেকে ২০ কিলোমিটার ও রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক থেকে এক কিলোমিটার দূরে ফুরমোন নিচপাড়ার অবস্থান।
পাড়ার লোকজন বলেন, স্বামীরা দৈনিক মজুরি করে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা রোজগার করেন। তাও সব সময় কাজ পান না। আবার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লে রোজগার বন্ধ থাকে। তখন অর্ধাহারে-অনাহারে থাকতে হয়। এরপর পাড়ার সব নারী ঐক্যবদ্ধ হলেন। শুরু করলেন সবজি চাষ। আশপাশের বনে গিয়েও বিভিন্ন সবজি সংগ্রহ করেন তাঁরা। পরে পাড়া থেকে এক কিলোমিটার দূরে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে খামারপাড়া এলাকায় সেই সবজি বিক্রি করেন। সবজি বিক্রি করে দৈনিক আয় হতে থাকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে। দিনে দিনে আয় বেড়েছে তাঁদের। এখন আয় হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। এসব সবজির মধ্যে রয়েছে কলার মোচা, বাঁশ কোরল, বনের বড় আলু, পেঁপে, কলা, মিষ্টি কুমড়া, শিম, সাবারাং পাতা, আদা ও কচু।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ফুরমোন পাড়া উত্তর-দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে বড় ঢালু। পূর্ব দিকে টিলা বেয়ে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে যাওয়ার রাস্তা। পাড়ায় কেউ কেউ সবজি বিক্রি করে টিনের ছাউনি ও আধা পাকা ঘরও তুলেছেন।
ফুরমোন নিচপাড়ার সুমিতা চাকমা ও মিলেবো চাকমা বলেন, ‘প্রতিদিন সবাই সকালে হালকা নাশতা করে জুম ও বনে সবজি সংগ্রহ করতে বের হই। দুপুরের মধ্যে চলে আসি। খাওয়াদাওয়ার পর সংগ্রহের সবজি নিয়ে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম খামারপাড়া এলাকা বসি। সেখানেই ক্রেতারা আসেন। আমরা সবজি বিক্রির টাকা সংসারের কাজে খরচ করি। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচও সেখান থেকে দেওয়া হয়।’
পাড়ার বাসিন্দা আরেক নারী বাসন্তী বালা চাকমা বলেন, ‘খামারপাড়া এলাকায় সবজি বিক্রি করায় আমাদের খরচ অনেক কমেছে। এর আগে রাঙামাটি শহরে সবজি বিক্রি করতে যেতাম। যে টাকা পেতাম তা দিয়ে অনেক সময় যাতায়াত ভাড়াও উঠত না। কিন্তু এখন স্বামীদের চেয়ে বেশি রোজগার করি আমরা। সংসারেও সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।’
ফুরমোনপাড়ার বিমল চাকমা বলেন, পাড়ার সব নারী সবজি বিক্রি করার পর এখন সংসারে অভাব অনেকটা দূর হয়ে গেছে।
রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের দোকানি শুক্র চাকমা বলেন, ফুরমোন নিচপাড়ার নারীদের সবজি বিক্রির কারণে দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত খামারপাড়া এলাকা জমজমাট থাকে।
পাড়ার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে এসব পরিবার নানিয়ারচর ও কাউখালী উপজেলা থেকে উদ্বাস্তু হন। প্রতিবছর তাঁরা এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে স্থানান্তরিত হয়ে জুমচাষ করতেন। কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা পান না। স্থায়ী কোনো ঠিকানা ছিল না তাঁদের। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে ফুরমোন উঁচু টিলার নিচে তাঁরা বসতি গড়েন। নাম দেওয়া হয় ফুরমোন নিচপাড়া।
সাপছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মৃণাল কান্তি চাকমা বলেন, ফুরমোন নিচপাড়ার লোকজন সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতায় এখনো আসেনি। এর আগে তারা পাহাড় থেকে পাহাড়ে স্থানান্তরিত অবস্থায় ছিল। সম্প্রতি রাঙামাটি রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি থেকে ৩০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে তাদের। ভবিষ্যতে সরকারি সাহায্য পেলে তাদের দেওয়া হবে।
তিনি আরও জানান, পাড়ার বেশির ভাগ লোক নিরক্ষর হওয়ায় দিনমজুরি ছাড়া কিছুই করতে পারে না। সে জন্য নারীরা রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে জুম ও বনের সবজি বিক্রি করে সংসারে স্বামীকে সহযোগিতা করছেন।
Comments