স্বভাবগত অপরাধী না হওয়ায় ৪ জনের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ বিশ্বজিত্ হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

স্বভাবগত অপরাধী না হওয়ায় ৪ জনের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ
পুরান ঢাকার দর্জি দোকানি বিশ্বজিত দাস হত্যা মামলার হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। ওই রায়ে বলা হয়েছে, বিশ্বজিত কোনো রাজনৈতিক দল করতো না। সে ছিল নিরস্ত্র এবং নিরীহ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র যারা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তারা প্রকাশ্য দিবালোকে বিশ্বজিতকে নির্দয় ও নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এই হত্যাকান্ড ছিলো বর্বরোচিত। হত্যাকান্ডটি পূর্বপরিকল্পিত না হলেও হামলাকারীদের সম্মিলিত উন্মত্ত আক্রমণের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। আর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিল ও রাজন তালুকদার মরণঘাতী অস্ত্র দিয়ে বিশ্বজিতকে মারাত্মকভাবে জখম করে। তাদের এই অপরাধ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং গোটা যুব সমাজের সঙ্গে মানানসই নয়। এ কারণে তাদের মৃত্যুদণ্ডের সাজা হ্রাসের ক্ষেত্রে আদালত ন্যুনতম কোন সহানুভূতি দেখাতে পারে না।

রায়ে বলা হয়, অভিযুক্তদের নেতারা বলেছিলো ১৮ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ কর্মসূচি প্রতিহত করতে হবে। যারা প্রতিহতের নির্দেশ দিয়েছিলো তারা ছিলো ঘটনার আড়ালে। এখন দণ্ডপ্রাপ্ত অনুসারীদের ফাঁসির রশিতে রেখে সেসব নির্দেশদাতারা দৃশ্যপটের বাইরে চলে গেছে। তবে স্বভাবগত অপরাধী না হওয়ায় এবং অতীত রেকর্ড (ক্রিমিনাল রেকর্ড) পরিষ্কার থাকায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদ, ইমদাদুল হক ওরফে এমদাদ, জিএম রাশেদুজ্জামান ওরফে শাওন ও মীর মো. নূরে আলম লিমনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দণ্ড দিয়েছে হাইকোর্ট।

আদালত বলেছে, এরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও তারা বিশ্বজিতকে মারাত্মকভাবে আঘাত করেনি। তাদের অপরাধ শাকিল ও রাজনের মত নয়। এ কারণে মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দেওয়া হলো। এছাড়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও হত্যাকান্ডে অংশ না নেয়া, সাক্ষীদের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য এবং সন্দেহের সুবিধায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাইফুল ইসলাম ও কাইয়ুম মিয়া টিপু এবং যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত এএইচএম কিবরিয়া ও গোলাম মোস্তফাকে খালাস দিয়েছে আদালত। রায়ে বলা হয়েছে, ঘটনাস্থলের পাশে হঠাত্ বোমা বিস্ফোরণের কারণেই বিশ্বজিত আসামিদের হত্যার শিকার হয়।

বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ গত ৬ আগষ্ট এ রায় দেন। গতকাল বুধবার ৮০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ এ রায় প্রকাশ পেয়েছে। রায়টি লিখেছেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস। রায়ে ফৌজদারি অনেক মামলায় তদন্ত প্রভাবিত হওয়া ও ছাত্র রাজনীতির বর্তমান অবস্থা নিয়েও পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে।

রায়ে হাইকোর্ট বলেছে, আমাদের দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অস্বচ্ছ তদন্ত কার্যক্রম প্রতিরোধ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একটি সমাজে বাস করি। যে সমাজে বিত্তশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা অপরাধ সংঘটন করে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে খুব সহজেই তদন্তকে প্রভাবিত করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দায়মুক্তি ভোগ করে থাকে। এমন অনেক মামলায় দেখা গেছে পুলিশ এবং অপরাপর তদন্ত সংস্থা, চিকিত্সক, বিশেষজ্ঞরা মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়ে অপরাধীকে সহযোগিতা করেছে। তারা এটা করে রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রভাব খাটিয়ে। কখনও কখনও আর্থিক বা অন্য কোনোভাবে লাভবান হওয়ার জন্য বেআইনিভাবে তারা এরকমটি করে থাকে। আমরা (আদালত) অসত্-অস্বচ্ছ তদন্তকাজ কোনোভাবেই চলতে দিতে পারি না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগ যদি ভূমিকা না রাখে, নিরাপরাধ জনসাধারণকে নিরাপত্তা না দেয় তাহলে আইনের শাসন মুখ থুবড়ে পড়বে।

সাজা হ্রাস ও খালাসের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায়ে যা বলা হয়েছে

রায়ে হাইকোর্ট বলেছে, ঘটনার ভিডিও ক্লিপিং, স্থিরচিত্র ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে হাইকোর্ট বলেছে, মামলার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী পার্বতী হালদার হালদার, চা বিক্রেতা মো. শহিদ ও রিকশা চালক রিপন সরকার কাঠগড়ায় সাইফুলকে আসামি হিসেবে চিহ্নিত করেনি। সাইফুলকে বারবার রিমান্ডে নেয়া হলেও সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়নি। অন্যান্য অভিযুক্তদের ঢাকার বাইরে থেকে গ্রেপ্তার করা হলেও সাইফুলকে উত্তরার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার এ আচরণ প্রমাণ করে ঘটনার সঙ্গে সে সম্পৃক্ত ছিলো না। এ কারণে শুধু মাত্র নাহিদ ও শাকিলের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে তাকে সাজা দেওয়া যথাযথ হবে না। এ কারণে সাইফুল খালাস পাবার যোগ্য। আসামি কাইয়ুম মিয়া ওরফে টিপুর ক্ষেত্রে আদালত বলেছে, এটিএন বাংলার ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে সে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল মাত্র। স্থিরচিত্রেও তার উপস্থিতি দেখা যায়। এতে আদালত চিন্তা করতে পারে না যে সে ঘটনার সাথে জড়িত। রায়ে বলা হয়েছে, ভিডিও ফুটেজ এবং স্থির চিত্রে গোলাম মোস্তফার উপস্থিতি দেখা না যাওয়ায় তার সাজা বহাল রাখা নিরাপদ মনে করে না হাইকোর্ট। এ কারণে সন্দেহের সুবিধায় সে খালাস পাওয়ার যোগ্য। ঘটনাস্থলে এএইচএম কিবরিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। শুধুমাত্র দাঁড়িয়ে থাকার কারণে তাকে হত্যা মামলায় সাজা দেওয়া যথাযথ নয়।

লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নিয়েও প্রশ্ন

হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সাক্ষ্য এবং ভিডিও চিত্রে বিশ্বজিতের শরীরে একাধিক আঘাতের উল্লেখ থাকলেও মামলার সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে একটি মাত্র আঘাতের কথা এসেছে।  তবে প্রতিবেদন দু’টিতে আঘাতের স্থানের অমিল রয়েছ। এ ধরণের রিপোর্ট ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অন্তরায়। আদালত বলেন, একটি অস্বচ্ছ তদন্ত সামাজিকভাবে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে এবং সমাজে এ ধরনের অপরাধ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিতে পারে। ফলে ন্যায়বিচারের স্বার্থেই এ দুটি (সুরতহাল এবং ময়নাতদন্ত) বিষয়ে অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন।

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপির ডাকা সকাল-সন্ধ্যা অবরোধের সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভেবে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে ছাত্রলীগের একদল কর্মী বিশ্বজিতকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে।

ইত্তেফাক/নূহু

Comments

Popular posts from this blog

অবিবাহিত মেয়ের বুকে দুধ, এই ভিডিওটি অবশ্যই একা একা দেখবেন !

টুইন টাওয়ারে ৯/১১ জঙ্গি হামলার ৫টি 'চমকপ্রদ' তথ্য

তৈরি করুন শীতের ভাপা পিঠা