মিয়ানমারজুড়ে রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে শুধুই ঘৃণা
মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনের ঘটনায় সারা বিশ্ব নিন্দাজ্ঞাপন করছে, তাদের কষ্টে সমব্যথী হচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমারজুড়ে রোহিঙ্গাদের প্রতি সমাজের কোনো অংশেরই কোনো সমবেদনা নেই, বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত এই গোষ্ঠীটির প্রতি রয়েছে তাদের তীব্র ঘৃণা।
নিউইয়র্ক টাইমসের বিশেষ প্রতিবেদনে মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ, সরকারি কর্মকর্তা, বিরোধী দলের রাজনীতিবিদ এমনকি মানবাধিকার কর্মীদের ভাষ্যেও উঠে এসেছে রোহিঙ্গাদের প্রতি সম্মিলিত ঘৃণার পরাবাস্তব চিত্র। তাদের সবার ধারণা রোহিঙ্গারা নিজেরাই এসব করে বিশ্ববাসীর সহানুভূতি ছিনতাই করতে চাইছে।
জাতিসংঘসহ বিশ্বের সব মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণের বর্ণনা উঠে এসেছে। গত ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশনে’ ৬ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। আর এতে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন রাখাইনের রাজধানী সিতওয়ের দামারামা আশ্রমের প্রধান ভিক্ষু উ থু মিন গালা। ৫৭ বছর বয়সী এই মহন্ত বলেন, রোহিঙ্গা মুসলিমরা কখনো মিয়ানমারের ছিল না। তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের কারণে তারা স্থানীয় বৌদ্ধদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করেছিল। কিন্তু এখন হয়তো ‘কোনো ভাবে’ তারা চলে গেছে।
তিনি বলেন, আমরা এ জন্য ভগবান বুদ্ধকে ধন্যবাদ জানাই। তারা আমাদের ভূমি, খাবার এবং পানির দখল নিয়েছিল। আমরা কোনোদিন তাদের ফেরত নেব না।
রোহিঙ্গাদের গ্রামে অগ্নিকাণ্ড বেসামরিকদের প্রতি আক্রমণের ঘটনার মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য হচ্ছে রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের উপর আক্রমণ করছে। মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ও রাখাইনে ক্ষমতাসীন এনএলডির প্রতিনিধি ড. ওয়াইন মিছাত বলেন, এখানে সেনাবাহিনীর মুসলিম বেসামরিক ব্যক্তিদের হত্যার কোনো ঘটনা ঘটেনি। মুসলিমরা নিজেদেরই হত্যা করেছে। সাক্ষাতকারে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা প্রমাণের কথা উল্লেখ করলে তিনি বলেন, বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ভাষ্য যাচাই করে দেখতে কোনো প্রতিনিধি পাঠায়নি মিয়ানমার। প্রতিবেদকের পরামর্শে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে সেটা করা হতে পারে।
রোহিঙ্গাদের মুখের ভাষাটা বাংলার কাছাকাছি এবং তাদের চেহারাও মিয়ানমারের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী থেকে ভিন্ন। তবে রাখাইনে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাস করে আসছে। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময়ে রাখাইনের বৌদ্ধ জনগণ জাপানের পক্ষ নেয় যেখানে রোহিঙ্গারা ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বন করলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাতের সূচনা হয়।
১৯৪৮ সালে মিয়ানমার বা বার্মা স্বাধীন হওয়ার পরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক ছিল। ১৯৬২ সালে সামরিক সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পরে তাদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া শুরু হয়। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে।
এমনকি তাদের রোহিঙ্গা নামটিও ছিনিয়ে নেয় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাঙ্গালি বলে অভিহিত করে এটা বোঝাতে যে তারা মিয়ানমারের স্থানীয় নয় বরং বাংলাদেশের। সাধারণ জনগণ তাদের ‘কালার’ নামে ডাকে, যে নামে মিয়ানমারের সব মুসলিমকে ডাকা হয়।
রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর রাজনীতিবিদরাও রোহিঙ্গাদের রাখাইন ছেড়ে পালিয়ে যাওয়াকে ভালো বিষয় হিসেবে বিবেচনা করছে। রাথেডং শহর থেকে নির্বাচিত রাখাইন গোষ্ঠীর এক পার্লামেন্ট সদস্য বলেন, সব বাঙ্গালি তাদের স্কুলের ধর্মীয় বইয়ে হত্যা ও আক্রমণ করতে শেখে। ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে একসাথে থাকা অসম্ভব।
ধার্মিকদের দেশ মিয়ানমারের নৈতিক মানদণ্ডের নির্ধারক বৌদ্ধভিক্ষুরা। তারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রচারণা চালিয়ে জনমানসে রোহিঙ্গাদের একটি বিকৃত ছবি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। জনপ্রিয় ভিডিওতে তারা রোহিঙ্গাদের ‘সাপ’ ‘কুকুরের চেয়েও অধম’ বলে অভিহিত করেন।
দামারামা আশ্রমের প্রধান ভিক্ষু উ থু মিন গালানের দাবি, কর্তৃপক্ষ অস্ত্রভর্তি রেডক্রসের গাড়ি আটক করেছিল যা রোহিঙ্গা জঙ্গিদের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। রেডক্রস এই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করে। এই মহন্ত বলেন, আমরা বিশ্বসমাজকে বিশ্বাস করি না। তারা জঙ্গিদের পক্ষ নিচ্ছে। সিতওয়ের আরেক আশ্রমের মহন্ত নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদককে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেন এবং তাকে ‘কালার প্রেমী’ বা মুসলিম প্রেমী বলে অভিহিত করে।
বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী মিলিয়ে মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ মুসলিম। ২০১৫ জাতীয় নির্বাচনে কোনো বড় রাজনৈতিক দল থেকে কোনো মুসলিম মনোনয়ন পায়নি, এবং পার্লামেন্টেও কোনো নির্বাচিত মুসলিম সদস্য নেই। মিয়ানমারের স্বাধীনতার পরে প্রথম ঘটল এমন।
মিয়ানমারে মুসলিম মুক্ত গ্রামও রয়েছে। মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় শহর ইয়াংগুনের কাছে সিন মা কাও গ্রাম এমন একটি। সেই গ্রামের প্রশাসক উ আয়ে সুয়ে বলেন, মিয়ানমারের মুসলিম মুক্ত গ্রাম প্রশাসনের দায়িত্বে থাকায় আমি গর্বিত। কালাররা এখানে স্বাগত নয় কারণ তারা সহিংস এবং অনেক স্ত্রীর কারণে তাদের জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। আয়ে সুয়ে বলেন, তিনি এখন পর্যন্ত কোনো মুসলিমের সঙ্গে দেখা হয়নি। তিনি ‘সঠিক খবরের’ জন্য ফেসবুককে ধন্যবাদ দেন।
অং সান সু চির এনএলডির নেতাদের ধারণা যে দেশে রোহিঙ্গাদের প্রতি এত বিদ্বেষ সে দেশে সু চি যদি রোহিঙ্গাদের পক্ষ নিতে যান তাহলে সেটা হবে রাজনৈতিক আত্মাহুতির সমতুল্য। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বৈশ্বিক চাপকে তারা মিয়ানমারে আভ্যন্তরীণ জটিলতা বুঝতে অক্ষমতা থেকে শুরু করে মিয়ানমারের উন্নয়ন ঠেকানোর চেষ্টা হিসেবে মনে করেন।
এনএলডির মুখপাত্র উ নিয়ান উইন বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাব, তারা যাতে এটা স্বীকার করে যে এই মুসলিমরা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী এবং এই সংকট আমাদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন।
সামরিক জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় ১৭ বছর কারাভোগ করা উ কো কো গি ও বললেন জাতীয় স্বার্থের কথা। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘসময় ধরে মানবাধিকার রক্ষায় লড়ে এসেছি এবং শাস্তি ভোগ করেছি। কিন্তু এই ইস্যুতে আমরা সবাই এক কারণ আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি সমর্থন করতে হবে।
তিনি যোগ করেন, আমরা ভারত ও চীনের মধ্যে অবস্থিত ছোট একটি রাষ্ট্র। যদি পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের বেশি সমালোচনা করে তাহলে তারা আমাদের চীন ও রাশিয়ার কোলে ঠেলে দেবে।
গত মাসে রাশিয়া ও চীন নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ওঠা নিন্দা প্রস্তাব ভেটো দিয়ে বাতিল করে দেয়।
রোহিঙ্গাদের উপর ত্রাণ সরবরাহে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর উপর অবরোধ আরোপ করা হয়। গত মাসে মাইবোন শহরে রাখাইন নারীরা রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে ত্রাণ সরবরাহ আটকে দেয়। কিন্তু স্থানীয় একজন উ টিন টিন নামের এক রাখাইন ট্রি শো চালক রোহিঙ্গাদের কাছে ত্রাণ পৌছিয়ে দেয়। এরপরে বিক্ষুব্ধ জনগণ উ টিন টিনের স্ত্রীকে বৌদ্ধ আশ্রমে নিয়ে গিয়ে পেটায় এবং তার চুল কেটে দেয়। তার স্ত্রীকে জাতীয় প্রতারক অভিহিত করা হয়।
স্ত্রীর উপর হওয়া নিপীড়নের পরেও রোহিঙ্গাদের সরবরাহ পৌঁছে দেয়ায় কোনো অনুশোচনা নেই উ টিন টিনের। তিনি বলেন, তারাও তো মানুষ। তাদেরও আমাদের মত খেতে হয়।
ইত্তেফাক/সাব্বির
Comments