নির্বাচনে বিরোধী দল কি অংশ নেবে?
জাতি অনেকটা উদগ্রীব হয়ে আছে আগামী সাধারণ নির্বাচনের দিকে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠিত হয়েছে এবং পুনর্গঠিত কমিশন তাদের পরিকল্পিত কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে।
খ. নির্বাচনের পরে বর্তমান সংসদ সদস্যরা রাষ্ট্রপতির আহ্বানে সংসদ সভায় অংশগ্রহণ করে সংবিধানের ১২৪ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা বলে সংসদের মেয়াদ আরও বৃদ্ধি করলে তা ঠেকানোর ব্যবস্থা বা আইনগত ক্ষমতা কোনো কর্তৃপক্ষের আছে কিনা? উল্লেখ্য, সংবিধান মোতাবেক বর্তমান রাষ্ট্রপতি পরবর্তী সংসদ কর্তৃক পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত স্বীয় ক্ষমতায় বহাল থাকবেন।
গ. ক্ষমতাসীনদের পরিকল্পিত নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে যদি কোনো সহিংসতা বা অরাজকতা দেখা দেয় বা ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে অন্য কোনো পক্ষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করে বা উসকাইয়া দিতে চায় তাহলে তার দায়দায়িত্ব কি বিরোধী পক্ষকে বহন করতে হবে?
ঘ. ক্ষমতাসীনরা কোনো ছলচাতুরীতে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি করবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে? ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে উত্তেজনাকর অবস্থার আলামত শুরু হয়ে গেছে।
ঙ. সবচেয়ে ভয়াবহ যে প্রশ্নটি উদ্ভব হবে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায় বিরোধী পক্ষের থাকবে না যা প্রায় নিশ্চিত। কারণ সংবিধানের ১২৪ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার লেখা আছে এই সংবিধানের অধীনে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বা প্রয়োজনীয় যে কোনো আইন যেমন নির্বাচনী সীমানা পুনঃনির্ধারণ, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং অন্য যে কোনো বিষয় যা সংসদ গঠন যার জন্য প্রয়োজন এমন সব আইন করতে পারবে। যার ফলে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ উপ-অনুচ্ছেদের ‘ক’ অধীনে নির্বাচন হওয়ার পরেও চলমান সংসদ সেই নির্বাচনকে বাতিল করে দেওয়ার সম্পূর্ণ সাংবিধানিক ক্ষমতা রাখে। ক্ষমতাসীনদের বিরূপ ফল প্রাপ্তিতে সংবিধানের ১২৪ ধারা প্রয়োগ হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায় তা অবশ্যই বিরোধী পক্ষ খুঁজতে পারে যা খুবই স্বাভাবিক।
উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর সুস্পষ্ট জবাব না নিয়ে বিরোধী কোনো পক্ষ ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে তাদের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে তার নিশ্চয়তা না পেয়ে সরকার বিরোধী কোনো পক্ষ ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বা করা উচিত বলে পৃথিবীর কোনো ব্যক্তি যদি মনে করেন, তাহলে মনে হয় ওই ব্যক্তি চরম ভাববাদী, স্বপ্নবিলাসী ও আত্মভোলা একজন মহামানব। কিন্তু সময়ের দুর্ভাগ্য হলো, বর্তমান পৃথিবীতে শুধু ক্ষমতাসীনরা ছাড়া এ রকম মহামানব হওয়ার সুযোগ অন্য কারও নেই!
বর্তমান সংবিধানের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী আগামী নির্বাচন হতে হবে। এখন সেই নির্বাচন ‘ক’ উপ-ধারায় হবে, না ‘খ’ উপ-ধারায় হবে তা হলো সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। যদি নির্বাচন কমিশন মনে করে, আগামী সংসদ নির্বাচন ‘ক’ উপ-ধারায় অনুষ্ঠিত হতে হবে, তাহলে এখন থেকেই একপক্ষীয় নির্বাচনী প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশন শুরু করে দিতে পারে। কারণ যদি ‘ক’ উপ-ধারা অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে ক্ষমতাসীনদের বিরোধী কোনো পক্ষই ওই নির্বাচনে স্বইচ্ছায় অংশগ্রহণ করতে রাজি হবে না, তা এক রকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। তবে যদি নির্বাচন কমিশন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করাতে আগ্রহী হন তাহলে নতুন করে নির্বাচনী নকশা আঁকতে হবে। যেহেতু সরকারবিরোধী পক্ষের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সম্ভাবনা প্রবল। তাই তাদের কীভাবে নির্বাচনে আনা যায়, তার বিধি ব্যবস্থা এখন থেকেই শুরু করে দিতে হবে। শুধু উন্নয়নের ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকারবিরোধীদের নির্বাচনে নিয়ে আসা খুবই সহজ হবে বলে মনে হয় না। বরঞ্চ তা দুঃসাধ্য হয়ে যেতে পারে। সরকার আগামী নির্বাচন নিয়ে বেকায়দায় বা বিরূপ অবস্থায় আছে। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কৌশল বা অভিজ্ঞতা কোনোটি আগামী নির্বাচনে কাজে লাগবে না, তা প্রায় নিশ্চিত। তাই আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করাতে না পারলে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সমস্যা বেশি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশে যে রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে বা যে রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিমান তার কোনো উন্নতি না হলে সব পক্ষের অংশ বিশেষ করে যাদের গুরুত্ব বেশি তাদের নিয়ে গ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা আরও বেশি ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বর্তমান ক্ষমতাসীন পক্ষ যদি তাদের বিরোধী পক্ষের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে না পারে তাহলে সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এখন এই সমঝোতা বৈরিতাপূর্ণ হবে, না আপসমূলক হবে— তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে ক্ষমতাসীনদের মনোভাব, তাদের কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ ও তা অর্জনের গৃহীত পরিকল্পনার ওপর।
যেহেতু উপ-অনুচ্ছেদ ‘ক’ অনুযায়ী ক্ষমতাসীনদের পাতানো ও পরিকল্পিত নির্বাচনে বিরোধী পক্ষের অংশগ্রহণ করে তাদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন বা তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা অত্যন্ত অনিশ্চিত সেখানে জেনেশুনে বিরোধী পক্ষ বিষ পান করবে কিনা তার সিদ্ধান্ত এককভাবে বিরোধী দলকেই নিতে হবে। তবে বিরোধী দল ‘ক’ উপ-অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচনে যেতে সম্মত হলে তাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিষ পান করতে হতেই পারে। আর যদি ‘ক’ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত এখনই চাউর করে দেয়, তা হলে বিষ পান করা এখন থেকে শুরু হয়ে যাবে। বিভিন্ন কারণে বিশেষ করে বিশ্ব রোহিঙ্গা ত্রাণ বাণিজ্যের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন অনেকটা ক্ষমতাসীনদের বিরোধী পক্ষের অনুকূলে। এ অবস্থাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন, বিশ্লেষণ এবং এখন অহেতুক রাজনৈতিক নাড়াচাড়া না করে অন্তত আরও নয় মাস ধৈর্য ধরে থেকে নিজেদের শক্তি অর্জন করে আগামী বর্ষার পর পর রাজনীতির তথা নির্বাচনের মাঠে ব্যাপকভাবে তৎপর হতে পারলে সংবিধানের ‘ক’ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন থেকে জাতিকে অব্যাহতি দেওয়া সম্ভব হবে। যদি উপ-অনুচ্ছেদ ‘ক’ অনুযায়ী নির্বাচন সংঘটিত না হয়, তাহলে ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ সালের মধ্যে সংসদ বিলুপ্ত করা ছাড়া জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের অন্য কোনো বিকল্প থাকবে না। উপ-অনুচ্ছেদ ‘ক’ অনুযায়ী সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে যদি নির্বাচন করা সম্ভব না হয়, তাহলে জানুয়ারি ২০১৯ সালের প্রথম দিকেই সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ ৩-এর ‘খ’ অনুযায়ী পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে। কাজেই ‘খ’ উপ-ধারার নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো, সংসদ বিলুপ্ত হতে হবে এবং সংসদ বিলুপ্ত হইলে সংবিধানের ১২৪ ধারা প্রয়োগ করার কোনো সুযোগ কারও থাকবে না।
সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ এর ‘ক’ উপ-ধারা সরাসরি সংবিধানের ১২৪ ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কাজেই ‘ক’ উপ-ধারায় নির্বাচনে বিরোধী দল যাবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত বিরোধী দলকে অনেক ভেবেচিন্তে নিতে হবে এবং এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে ক্ষমতাসীনদের বিরোধী পক্ষের নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে টান দেবে। এ অবস্থান থেকে মুক্তি পেতে হইলে ক্ষমতাসীনদের বিরোধী পক্ষকেও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতায় অবশ্যই আসতে হবে। এখন সেই সমঝোতা চরম বৈরিতার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা হবে, না আপস ও গঠনমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছাবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র ক্ষমতা শুধু বিরোধী পক্ষেরই আছে। বিরোধী পক্ষের এখন যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন, আগামী এক বছর কোনো অবস্থাতেই তাদের জন্য সময়টা মধুময় হবে না। তাই বিরোধী পক্ষকে ঝুঁকি নিতেই হবে। তবে সেই ঝুঁকি হতে হবে অবশ্যই অত্যন্ত পরিকল্পিত, সুদূরপ্রসারী ও বস্তুনিষ্ঠ কর্মসূচিমূলক। যা বাস্তবায়ন করে অর্জন করা সম্ভব হবে জনগণের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। জনগণ চায় দুর্নীতিমুক্ত মেধাভিত্তিক গণতান্ত্রিক সমাজ ও শাসন ব্যবস্থা—যা আমাদের অর্জন করতেই হবে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্ব এর সঙ্গে জড়িত।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
Comments