মানুষ আর মানুষ : ছুটছে তারা আশ্রয়ের খোঁজে এম মাঈন উদ্দিন, উখিয়া সীমান্ত থেকে ফিরে
আসাদ আলীর লাশ কবর দিতে নিয়ে যাচ্ছে একদল রোহিঙ্গা। তারা দাবি করেছেন, নাফ নদী অতিক্রমের সময় মিয়ানমার বাহিনীর গুলিতে নিহত হন আসাদ আলী
কক্সবাজারের উখিয়া সদর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সড়কের পাশে ও পাহাড়ে এখন রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। দুচোখ যে দিকে যাবে শুধু মানুষ আর মানুষ দেখা যাবে। কোলে শিশু নিয়ে, কাঁধে বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে ছুটছে আশ্রয়ের আশায়। সম্বল বলতে পরনের কাপড় ছাড়া কিছু নেই তাদের কাছে। সড়কে খাদ্যবাহী কোনো গাড়ি দেখলে পেছন পেছন ছুটছে তারা। শুধু সামান্য ত্রাণের জন্য। এক প্যাকেট বিস্কুট পেয়ে তাদের চোখ মুখে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। মনে হয় পুরো পৃথিবী সে পেয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে। এক টুকরো পলিথিনের ছাউনি যেনো তাদের কাছে সোনার হরিণ। অথবা একমুঠো চিড়া পেলেও মনে হয় যেনো আকাশ পেয়ে গেছেন তারা। বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যক্তি ও সংগঠনের উদ্যোগে যাওয়া ত্রাণের গাড়িগুলোকে ঘিরে ধরছেন তারা।
গত দু'দিন উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে এসব চিত্র দেখা গেছে। এখনো খোলা আকাশের নিছে রয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। কেউ কোনো মতে প্লাষ্টিক দিয়ে পাহাড়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেও খাবারের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অনেকে বৃষ্টিতে ভিজে রোদে শুকাচ্ছেন। এখন এগুলো নিত্য চিত্র ওইসব এলাকার। এক একজন কয়েক দিন পায়ে হেঁটে, বৃষ্টিতে ভিজে, নদী-পাহাড় পার হয়ে বাংলাদেশে এসেও চরম দুর্ভোগে পড়েছে।
নিজ দেশের বসতঘর পুড়ে গেছে, লুট হয়েছে সম্পদ, গবাদিপশু হারিয়েছেন, পরিবারের কেউ না কেউ প্রাণ হারিয়েছে মিয়ানমার সৈন্যদের হাতে। সর্বস্ব হারিয়ে মাইলের পর মাইল দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কেবল প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। টেকনাফ থেকে উখিয়া পর্যন্ত সড়কের দুইধারে পাহাড়ে জঙ্গলে যে যেখানে পেরেছে অবস্থান নিয়ে আছে।
উখিয়া উপজেলার বালুখালী ক্যাম্পের অদুরে সড়কের পাশে বসে কাঁদছেন রাজিয়া। কোলে ১ বছরের শিশু মাজেদ। মাজেদও কান্না করছেন। মা-ছেলের কান্না দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি উপস্থিত অনেকে। কথা হয় রাজিয়ার সাথে। সে জানায়, তাদের এলাকায় মিয়ানমার সৈন্যরা রীতিমতো ভয়ঙ্কর তাণ্ডব চালিয়েছে। যাকে পেয়েছে তাকে মেরেছে। গুলি করেছে, কুপিয়েছে, ঘরে আগুন দিয়েছে। তার আপন ছোট ভাই আবদুস সালামকে সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করেছে। কেবল প্রাণে বাঁচতেই স্বামী নুর হোসেনকে নিয়ে এপারে এসেছেন। নুর হোসেনও অসুস্থ। এখনো থাকার জায়গা হয়নি তাদের। খোলা আকাশের নিছে পাহাড়ে দিন কাটছে তাদের। সামান্য খাবারের আশায় স্বামীকে পাহাড়ে রেখে সে সড়কের পাশে এসেছেন। শুধু রাজিয়া নয় এমন হাজার হাজার নারী-পুরুষের অবস্থা তার মতো।
এদিকে সীমিত সাধ্যের মধ্যেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সর্বস্ব দিয়ে রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য করছে। যদিও তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন যে কেউই। ফলে প্রাণে বাঁচতে রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের। এরমধ্যে উখিয়া টেকনাফের সামাজিক বনায়নের জায়গায় থাকার জায়গা দিতে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠছে স্থানীয় অসাধু লোকজনের বিরুদ্ধে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, গত ১২ দিনে কমপক্ষে দুই লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরমধ্যে গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত প্রবেশ করেছে অন্তত ৫০ হাজার। যদিও জাতিসঙ্ঘের অনুমান, গত ২৫ অক্টোবর থেকে এই পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে অন্তত তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে থাকতে পারে। আরো ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা জিরো পয়েন্ট ও নো ম্যানস ল্যান্ডে অনুপ্রবেশের জন্য অপেক্ষমান।
একটি সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মিয়ানমাওে থাকা অন্য রোহিঙ্গা মুসলমানদের দেশ ছাড়তে আল্টিমেটাম দিয়েছে সে দেশের সেনাবাহিনী। সে কারণে আরো লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
থাইংখালীপয়েন্টের নো ম্যানসল্যান্ডে গিয়ে দেখা গেছে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় থাকা অন্তত ১০ হাজার রোহিঙ্গার চরম দুর্বিষহ জীবনের চিত্র। সেখানে বাংলাদেশ অংশের নাফ নদীর পাশে দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চিংড়ি ঘেরগুলোর মাঝখানের ছোট ছোট রাস্তায় অপেক্ষা করছে তারা। কারো পেটে দানা পানি নেই। কেউ কেউ ৪০-৫০ কিলোমিটার দূর থেকে হেঁটে এসেছেন।
কথা হয় ঢেকিবুনিয়া এলাকার আকলিমা বেগমের সাথে। কোলে তার ১৫ দিনের নবজাতক। তাকে কোলে নিয়েই নদী পার হয়েছেন। নবজাতকের নাম জানতে চাইলে রশিদা বলেন, ‘নাম কিভাবে রাখবো। বাঁচাতে পারি কিনা তাতো জানি না। দুধ পাচ্ছে না। শুধু কান্না করছে।’
৭০’র বেশি বয়স মাফিয়া খাতুনের। এক ছেলে মারা গেছে ২০১২ এর দাঙ্গায়। দুই মেয়ের বড়জন মংডুতে থাকে। ছোটজন ও তার সন্তানদের নিয়ে মংডুর উত্তরাঞ্চলে থাকতেন তিনি। গত ২ সেপ্টেম্বর সেখানে তান্ডব চলার সময় পরিবারের বাকী সদস্যরা কে কোথায় গেছে খুঁজে পাননি। পরে গ্রামের অন্যদের সাথে উখিয়ায় আসেন তিনি। এতো কষ্ট করে কেনো আসলেন জানতে চাইলে বৃদ্ধার উত্তর, ‘মগরা মেরে ফেলবে, তাই চলে এসেছেন।’ এ সময় সন্তান ও নাতী-নাতনীর কথা বলতে বলতে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন বৃদ্ধা মাফিয়া।
রোহিঙ্গাদের মানবতার প্রশ্নে সরকার ব্যর্থ : দুদু
নিজস্ব প্রতিবেদক
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানবতার প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু। আজ শনিবার দুপুরে বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি-ঢাকা মহানগরীর উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে “মিয়ানমারে অব্যাহত রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণহত্যার প্রতিবাদে” এক মানববন্ধনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। দুদু বলেন, অনেক ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিভিন্ন দেশ সফর করেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রী আশ্চর্যজনক নীরবতা পালন করছেন। আমরা সরকারকে পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশবাসী এবং সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপ আলোচনা করে ঐক্যবদ্ধভাবে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ইস্যুটিকে জাতিসংঘে উত্থাপন করা হোক। এক্ষেত্রে অনির্বাচিত সরকার কূটনৈতিক ও মানবতা দুই ক্ষেত্রেই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
আন্তজাতিক ভাবে মানবতার ক্ষেত্রে এবং বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতেও তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তিনি বলেন, মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর টার্গেট করে গণহত্যা চালানো হচ্ছে। আমাদের প্বার্শবর্তী দেশ ভারতের সাথে আমাদের গভীর বন্ধুত্ব রয়েছে বলে এপাড়ের লোক ওপাড়ের লোক দাবি করে এবং সেই সাথে এই পাড়ের সরকার ঔপাড়ের সরকারও দাবি করেন, কিন্তু দুঃখজনক হলেও বেদনার কারণ এই, বর্তমানে রোহিঙ্গার প্রশ্নে ভারত সরকার বার্মার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে যা আমরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেখতে পাচ্ছি।
আমরা জানি গায়ের জােড়ের সরকারের পাশে কেউ থাকে না, অনির্বাচিত অবৈধ সরকারের সাথে কেউ থাকে না, রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে আমরা আবার সেটা দেখতে পেলাম। বিএনপির এই নেতা বলেন, ১৯৭১ সালে আমরা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তারা আমাদের সেই সুযোগটি দিয়েছিল, সেই ৭১ এর পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে আমরা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মানবিক দৃষ্টিতে বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে পারি। তারপর আলোচনার মাধ্যমে সংকট কাটিয়ে আমরা তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত দিতে পারি।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে একটা রাজনৈতিক সংকট আছে। কীভাবে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায় এ ব্যাপারে একটা আন্দোলন আছে, গুম-খুন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনগণকে রক্ষা করতেও আন্দোলন আছে, এর ভিতরে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছে আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।
মানববন্ধনে আরো বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভূইয়া, জাতীয়তাবাদী দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি কে.এম রকিবুল ইসলাম রিপন, কল্যাণ পার্টির ভাইস-চেয়ারম্যান সাহিদুর রহমান তামান্না প্রমুখ।
মানববন্ধনে আরো বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভূইয়া, জাতীয়তাবাদী দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি কে.এম রকিবুল ইসলাম রিপন, কল্যাণ পার্টির ভাইস-চেয়ারম্যান সাহিদুর রহমান তামান্না প্রমুখ।
Comments