লিবিয়ায় দালালচক্রের হাতে জিম্মি শতাধিক বাংলাদেশি
লিবিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশিদের ইতালিসহ ইউরোপের উন্নত দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে অপহরণ করছে কিছু দালাল। ভাগ্য বদলের আশায় শতাধিক প্রবাসী এরই মধ্যে দালালচক্রের ফাঁদে পা দিয়েছেন। ওই অপহরণকারীরা তাঁদের অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করছে। এরপর বাংলাদেশে থাকা পরিবারের কাছে ফোন করে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করছে। প্রবাসীর মুক্তির আশায় দেশে দালালচক্রের প্রতিনিধিদের কাছে মুক্তিপণের টাকাও দিচ্ছে স্বজনরা। এভাবে দফায় দফায় টাকা আদায় করা হলেও অপহৃত প্রবাসীর মুক্তি মিলছে না। লিবিয়ায় একটি অপহরণকারীচক্রে জড়িত ছয়জনকে বাংলাদেশ থেকে গ্রেপ্তারের পর এমনই তথ্য দিয়েছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেছেন, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তিনজন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট। এই চক্রটি ইতিমধ্যে অপহৃত প্রবাসীদের স্বজনের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
গতকাল রবিবার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পিবিআই ঢাকা মেট্রোর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব থানার ভৈরবপুর এবং নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার মাহমুদাবাদ পাগলা বাজার ও জংলী শিবপুর এলাকায় অভিযান চালানো হয়। গ্রেপ্তারকৃত ছয়জন হলো—কামাল উদ্দিন (৪৫), নাজনীন বেগম (৩৫), আবু কাশেম (৩৫), বেবী আক্তার (৩৫), মামুন মিয়া (৪২) ও নুরুল হক (৪৫)।
পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘লিবিয়াপ্রবাসী ১০০ থেকে ১২০ জন বাঙালিকে ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর কথা বলে জিম্মি করেছে একটি চক্র। তারা অপহৃতদের স্বজনের কাছে দেশে ফোন করে বিকাশ নম্বর দিয়ে কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রবাসী বাঙালিদের ২০-২৫ জন এ অপহরণচক্রে জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তিনি আরো বলেন, চক্রটি বিভিন্ন পরিবারের কাছ থেকে কয়েক দফায় পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা আদায় করেছে বলে প্রমাণ মিলেছে। এ চক্রের সদস্যদের প্রাথমিকভাবে নাম-পরিচয় পেয়েছি, তবে এর সঙ্গে বিদেশি কেউ জড়িত থাকার তথ্য আমরা পাইনি। ’
চক্রটি তিন-চার বছর ধরে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে জানিয়ে এসএস আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এ পর্যন্ত মুক্তিপণ পেয়ে কাউকে ছেড়ে দেওয়ার তথ্য আমরা পাইনি। পরিবার যত টাকাই দিচ্ছে, অপহরণকারীদের ডিমান্ড আরো বাড়ছে। সেই সঙ্গে চলছে নির্যাতনও। ’
অপহৃতদের উদ্ধারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমরা সেখানকার দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। সেখানকার বাঙালি কমিউনিটিকে বলেছি স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়গুলো জানাতে। ’
পিবিআই সূত্র জানায়, পরিবারের ভাগ্য বদলের আশায় ২০১২ সালে নওগাঁর বাসিন্দা আইয়ুব আলী (২৫) পাড়ি জমিয়েছেন লিবিয়ায়। চলতি বছরের জুলাইয়ে স্বদেশী কোনো ‘ভাই’ তাঁকে প্রস্তাব দেয় ইটালি যাওয়ার। এরপর তাঁকে লিবিয়ারই অজ্ঞাতপরিচয় স্থানে নিয়ে যায় সেই ভাই। এরপর চলতে থাকে অমানবিক নির্যাতন। আর সেই নির্যাতনের ছবি-ভিডিও দেশে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে চলতে থাকে মুক্তিপণ আদায়। কয়েক দফায় পাঁচ লাখ টাকা পাঠানোর পরও মুক্তি মেলেনি আইয়ুবের।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত আইয়ুবের বাবা তসলিম প্রামাণিক বলেন, ‘মুখোশ পরে ছেলেটারে ঝুলায়ে পিটাচ্ছে। এসব ছবি দেখে টাকা দিলাম। কিন্তু ছেলেটারে ছাড়ে না, তারা আবার টাকা চায়। সর্বশেষ ২০ হাজার টাকা ভিক্ষা করে পাঠিয়েছি’—বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন পঞ্চাশোর্ধ্ব তসলিম প্রামাণিক। তিনি কেঁদে বলেন, ‘ছেলের নির্যাতনের ছবি দেখে তার মা স্ট্রোক করে হাসপাতালে আছে। আপনারা আমার ছেলেসহ সবাইরে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন। ’ ওই সময় সাংবাদিকদের সামনেই ছেলেকে ফোন করেন তসলিম। সেই ফোনে অপহরণকারীদের সঙ্গে কথা বলে ছেলেকে মারধর না করতে অনুরোধ জানান তিনি। কথা শেষে অপহরণকারী আরো পাঁচ লাখ টাকা দাবি করছে—বলেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন তসলিম।
পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা জানান, আইয়ুব আলীর বাবা তসলিম প্রামাণিক এবং রুবেল (২৮) নামের আরেক প্রবাসীর ভাই রব্বানীর অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নামে পিবিআই ঢাকা মেট্রো। এরপর ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় শেরেবাংলানগর থানায় মামলা করেছে পিবিআই। চক্রের অন্য সদস্যদের আইনের আওতায় আনা এবং জিম্মি প্রবাসীদের উদ্ধারের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
Comments