রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে মংডুতে হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল


রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে মংডুতে হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরএসএ) সন্ত্রাসবাদের কারণেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মুসলিম রোহিঙ্গাদের হত্যা, নির্যাতন এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে—বিষয়টিকে এত সরলভাবে না দেখে এর পেছনে অন্য ‘রহস্য’ দেখছে দেশটির বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম। তাদের দাবি, অমানবিক নির্যাতন করে রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া এবং তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার নেপথ্যে অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক। বঙ্গোপসাগরের পাশে রাখাইন রাজ্যে মংডুতে চীনকে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ দিতে চায় মিয়ানমার। সে কারণেই রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিজেদের ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম বলছে, ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা শুরুর পর তড়িঘড়ি করে ৫ সেপ্টেম্বর একটি কম্পানি গঠন করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় নাফ রিভার গ্যালাক্সি ডেভেলপমেন্ট নামের ওই কম্পানির সঙ্গে আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইয়ের দিন ঘোষণা করা হয়েছে। মিয়ানমারের ফ্রন্টিয়ার ইরাবতি পত্রিকায় এসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবাধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধনের পেছনে শুধু কিছু বিদ্রোহীর কর্মকাণ্ডই দায়ী নয়; বরং সেখানে রয়েছে বিশাল বাণিজ্যের খেলা। মিয়ানমারে তেল ও খনিজ  সম্পদে ভরপুর। চীনা বিনিয়োগকারীরা বঙ্গোপসাগরের পাশে রাখাইন রাজ্যে খনিজ সম্পদ আহরণ, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও পাইপলাইন নির্মাণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বন্দর নির্মাণ করতে চায়। মিয়ানমারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে চীনের বড় ধরনের অবদান আছে।
একই সঙ্গে সেখানে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে।
ফ্রন্টিয়ার পত্রিকা বলছে, মংডুতে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। রাখাইন রাজ্যের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী ইউ কায়া আয় থেনের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকাটি বলছে, সরকার ২৯ সেপ্টেম্বর নাফ রিভার গ্যালাক্সি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ নামের ওই কম্পানির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করবে। প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলটি হচ্ছে নাফ নদের পাশে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা কানইয়ান চাউং গ্রামে। মন্ত্রী ইউ কায়া আয় থেনের উদ্ধৃতি দিয়ে ফ্রন্টিয়ার বলেছে, আগের সরকারই সেখানে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বর্তমান সরকার সেই পরিকল্পনাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিচ্ছে। এটি হবে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, যেখানে বিনিয়োগকারীরা জমি লিজ পাবেন অত্যন্ত কম দামে। তাদের কোনো কর পরিশোধ করতে হবে না।
ফ্রন্টিয়ারের প্রতিবেদনে নাফ রিভার গ্যালাক্সি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপকে রহস্যময় উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এদের পেছনে কারা রয়েছে তা অস্পষ্ট। ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা শুরুর কয়েক দিনের মধ্যেই তড়িঘড়ি করে ৫ সেপ্টেম্বর এই কম্পানিকে নিবন্ধিত করা হয়েছে। অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেছেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলটি হবে যৌথভাবে। সেখানে সাতজন বড় ব্যবসায়ী বিনিয়োগ করবে। তারা মংডু ও ইয়াঙ্গুনের ব্যবসায়ী। কিন্তু ওই সাতজন বড় ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করেননি মন্ত্রী। এতেই সন্দেহ তৈরি হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনা বিনিয়োগকারীরা জড়িত থাকতে পারেন নাফ রিভার গ্যালাক্সি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপের সঙ্গে।
রাখাইন রাজ্যে আরেক শহরের নাম কিয়াপফুতেও চার হাজার একর জমিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা রয়েছে চীনের। সেখানকার তেল ও গ্যাস টার্মিনালেও অর্থায়ন করেছে চীনের পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। জমি অধিগ্রহণের সময় জমির মূল্য পরিশোধ না করারও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।  
মিয়ানমারের আরেকটি পত্রিকা ইরাবতিতে গতকাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম পর্যায়ে রাখাইন রাজ্যে ১০০ একর জমির ওপর অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। পরবর্তী সময়ে সেটি আরো বাড়ানো হবে। তবে সাম্প্রতিক সহিংসতার কারণে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ কিছুটা ব্যাহত হয়। সহিংসতা কমে গেলে পরিস্থিতি শান্ত হলে অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজে গতি বাড়বে।
রাখাইনের রাজ্য সরকার বলছে, মংডু অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে পারবে। তাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। রাজ্য সরকারের এই বক্তব্যেই প্রমাণিত হয় যে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে চীনা বিনিয়োগকারীরা সরাসরি জড়িত আছে। মিয়ানমারে চীনের যে বড় ধরনের বিনিয়োগ পরিকল্পনা রয়েছে, সেটি ফুটে উঠেছে গত ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত মা মিংকিয়াংয়ের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, মিয়ানমারের চলমান সহিংসতার কারণে চীন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ সেখানে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও চীনের সমন্বয়ে (বিসিআইএম) অর্থনৈতিক করিডর বাস্তবায়নও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের যেমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে; ঠিক তেমনটি রয়েছে মিয়ানমারের সঙ্গে। অবশ্য চলমান সহিংসতা অতি দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে বলে আশাবাদী চীনের রাষ্ট্রদূত। চলমান সংকটে বাংলাদেশের পক্ষে না দাঁড়িয়ে চীন সরকার এরই মধ্যে মিয়ানমারের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। আর এর পেছনে মিয়ানমারে দেশটির বড় ধরনের স্বার্থ রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
রাখাইন রাজ্যে চলমান সংকটের পেছনে বহুমাত্রিক কারণ রয়েছে বলে রুশ সংবাদমাধ্যম স্পুিনকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ব্রিটিশ প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানেও বলা হয়েছে, এর পেছনে রয়েছে ব্যবসায়িক স্বার্থ। গার্ডিয়ানে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে প্রচুর খনিজ সম্পদ রয়েছে। সেখানকার কৃষি খাতও সম্ভাবনাময়। ২০১২ সালে মিয়ানমার সরকার তাদের সংসদে একটি আইন পাস করেছে, যেখানে শতভাগ বিদেশি মূলধন আনার পাশাপাশি ৭০ বছরের জন্য জমি লিজের সুযোগ রাখা হয়েছে। এতে বিদেশি অনেক ব্যবসায়ীর কাছে মিয়ানমার এখন বিনিয়োগের বড় ক্ষেত্র হিসেবে ধরা হচ্ছে।
ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ অব দ্য রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেসের সেন্টার ফর সাউথ ইস্ট এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও ওশেনিয়াবিষয়ক পরিচালক দিমিত্রি মোসিয়াকভের মতে, রাখাইন রাজ্যের উপকূলীয় এলাকায় হাইড্রোকার্বনের বিপুল রিজার্ভের দিকে চোখ রয়েছে আন্তর্জাতিক মহলের। মোসিয়াকভ বলেন, মিয়ানমারের সাবেক সেনাশাসক থান শুয়ের নামে অনেক গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে। পাশাপাশি আরাকানের উপকূলীয় অঞ্চলে হাইড্রোকার্বন রয়েছে বলে অনেকটাই নিশ্চিত। স্পুিনকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৪ সালে রাখাইনে বিপুল পরিমাণ জ্বালানিসম্পদের সন্ধান পাওয়ার পর সেখানে চোখ পড়ে চীনের। ২০১৩ সাল নাগাদ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য পাইপলাইন নির্মাণের কাজও শেষ করে দেশটি। পাইপলাইন মিয়ানমারের বন্দর শহর কিয়াউকফিউকে চীনের ইউনান প্রদেশের শহর কুনমিংকে যুক্ত করেছে। তেলের এ পাইপলাইনের মাধ্যমে পেইচিং মালাক্কা প্রণালি হয়ে মিডল ইস্টার্ন ও আফ্রিকান তেল সরবরাহের সুযোগ পায় পেইচিং। আর গ্যাস পাইপলাইনটি ব্যবহার করা হয় মিয়ানমারের উপকূলীয় ক্ষেত্র থেকে চীনে হাইড্রোকার্বন সরবরাহের জন্য। নতুন করে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে বলে অভিমত বিশ্লেষকদের।



মন্তব্য

Comments

Popular posts from this blog

অবিবাহিত মেয়ের বুকে দুধ, এই ভিডিওটি অবশ্যই একা একা দেখবেন !

টুইন টাওয়ারে ৯/১১ জঙ্গি হামলার ৫টি 'চমকপ্রদ' তথ্য

তৈরি করুন শীতের ভাপা পিঠা