রোহিঙ্গাদের আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছে নাইক্ষ্যংছড়ির বাতাস


আরাকান রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বোরচিত হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢালা সীমান্তের চেরারমাঠ বড়ছনখোলায় পালিয়ে এসেছে অন্তত ৫-৬ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক। খোলা আকাশের নিচে নানা সমস্যায় জর্জরিত মিয়ানমারের এ জনগোষ্ঠীর আর্তনাদে এলাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।
দীর্ঘ সময় অনাহারে থাকায় শারিরীক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন আশ্রয়প্রার্থীরা। ক্রমশই নেতিয়ে পড়ছেন তারা। খেতে না পেয়ে শিশুদের হাঁউমাউ কান্নায় ভারী হয়ে ওঠছে পরিবেশ। নিজেরা না খেতে পেয়ে শিশুদের বুকের দুধও দিতে পারছেনা রোহিঙ্গা মায়েরা। এই মূহুর্তে সেখানে খাদ্য, শিশু খাদ্য ও ঔষুদের প্রয়োজন। কিন্তু কোন স্বেচ্ছাসেবী বা মানবাধিকার সংস্থা এখনো সেখানে পৌঁছায়নি। তবে বাংলাদেশী বিভিন্ন সংগঠন মানবতার খাতিরে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর আগ্রহ দেখাচ্ছে ।
দূর দূরান্ত থেকে বাংলাদেশী নাগরিকরা গিয়ে তাদের সামান্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করলেও তা খুবই অপ্রতুল। বুধবার দুপুরে সরেজমিনে জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার চাকঢালা চেরারমাঠ বড়ছনখোলা এলাকায় এ দৃশ্য দেখা যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, এই পয়েন্ট আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা বাঁশের খুটিতে পলিথিনের ছাউনি টানিয়ে কোনোমতে পরিবার পরিজন নিয়ে দিনাতিপাত করছে। দুর্গম ওই এলাকায় পানীয় জলের ব্যবস্থা না থাকায় পাহাড়ের পাদদেশে গর্ত খনন করে হাজারো রোহিঙ্গা জীবন রক্ষা করছে। শত শত নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও যুবক খোলা আকাশের নিচে রোদে পুড়ছে আর বৃষ্টিতে ভিজছে। তবে যুবকদের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। পরিধানের কাপড় ছাড়া অধিকাংশের কাছে কিছুই নেই। কারো কারো হাতে সুটকেস, বস্তা, থলে ও হাড়ি পাতিল দেখা গেছে। এদের অনেকে শুক্রবারে পৌঁছেছে সীমান্তে আবার অনেকে শনি-রবিবারে ।
হাতে ধরে গণনা করা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গার অবস্থান নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তের জিরো পয়েন্টে। একদিকে বার্মিজ সেনাবাহিনী তাদের দিকে অস্ত্র তাক করে আছে আর অন্যদিকে বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড তাদের প্রবেশ করতে না দেয়ার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে রয়েছে। খোলা আকাশের নিচে, পাহাড় ও বিলের ধারে গত ৪ দিন ধরে মানবেতর জীবন-যাপন করা এসব আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের আর্তনাদে মন কাঁদছে না সীমান্তরক্ষীদের।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশী সীমান্তরক্ষী জানান, রোহিঙ্গাদের ঢুকতে না দেয়ার জন্য উপরের নির্দেশ আছে। আমরা কোনভাবে আমাদের দায়িত্বের অবহেলা করতে পারি না।
একাধিক রোহিঙ্গার সাথে কথা হলে তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। পাঁচ বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত সবার মুখে একই কথা- মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও বিজিপির অত্যাচার নির্যাতন আর গুলি থেকে বাচঁতে তারা সবাই পালিয়ে এসেছেন।
রোহিঙ্গা নাগরিক নূর মোহাম্মদ, খলিল, ফকির আহমদ, সোনাইয়্যা এ প্রতিবেদককে বলেন- নিজ দেশে তারা ফিরতে চান। কিন্তু সেদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পাশের দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা বলেন, ৪-৫ দিন ধরে মিয়ানমার বাহিনীর ছোঁড়া গুলি মোকাবেলা করে ছিলাম। কিন্তু আকাশে হ্যালিকপ্টার আর উপর্যুপরি গুলির কারণে শেষ পর্যন্ত তাদের নিজ গ্রাম ছাড়তে হয়েছে।
এদিকে সীমান্তে রোহিঙ্গা অনপ্রবেশের কারণে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সভা করেছে বিজিবি, পুলিশ ও জেলা প্রশাসন।
গত বুধবার বেলা ১১টায় নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে আয়োজিত সভায় বান্দরবান জেলা প্রশাসক দীলিপ কুমার বণিক বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের অভ্যান্তরীণ বিষয়। এটা বাংলাদেশের কোনো সমস্যা নয়। যেহেতু এটি দুই দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়, সরকারের তরফ থেকে মিয়ানমারের সাথে যোগাযোগ চলছে। এই বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে রোহিঙ্গাদের যাতে সসম্মানে তাদের দেশে নিয়ে যায় কূটনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ চলছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে মিয়ানমারের রাষ্ট্রপক্ষকে তলব করা হয়েছে। বিজিবির পক্ষ থেকেও যোগাযোগ চলছে। বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ যাতে আমাদের কোনো লোক নিতে না পারে, রোহিঙ্গাদের সহায় সম্পদ লুট করে নিতে না পারে সে লক্ষ্যে আইন শৃঙ্খলা বিষয়ক সভা করেছি।
বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের ৩১ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ারুল আযীম বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে কোনোভাবেই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া যাবে না। রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আমাদের কেউ কেউ স্বল্প মূল্যে তাদের কাছ থেকে গরু ছাগল আনার চেষ্টা এবং রোহিঙ্গা তরুণীদের কাজের প্রলোভন দেখিয়ে আনার চেষ্টা করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। প্রয়োজনে তাদের গুলি করার হুঁশিয়ারি দেন বিজিবির এই কর্মকর্তা।
তিনি আরও বলেন, গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছে, যা বিজিবি প্রতিরোধ করে দিয়েছে।
বিজিবি কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডারের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে থাকা এই কর্মকর্তা বলেন, টেকনাফ সীমান্তের নাফ নদী দিয়ে যেসব রোহিঙ্গা আসার চেষ্টা করেছে, তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। টেকনাফ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে এখনো আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছে। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ৩৪ ও ৩১ বিজিবির দায়িত্ব পালন করছি। বিগত দিনে মিয়ানমারে সহিংসতার সময় এই সীমান্ত দিয়ে কখনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেনি। কিন্তু সম্প্রতি সীমান্তের ৪৪-৪৬ নং পিলার এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দুই দেশের জিরো পয়েন্টে এসে আশ্রয় নিয়েছে। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা শুধুমাত্র ইউনিফর্মধারীদের দায়িত্ব নয়, সব ধর্মের, সব দল মতের মানুষকে বর্তমান পরিস্থিতিকে মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে হবে।
বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায় বলেন- বিজিবি আন্তরিকভাবে সীমান্তে কাজ করছে। পুলিশের পক্ষ থেকেও ফোর্স এবং টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের সাথে মানবিক আচরণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। দুই দেশের মধ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান হবে। এই আপৎকালিন সময়টুকুতে যাতে আমাদের ভূমিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত কঠোরভাবে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে।
নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তসলিম ইকবাল চৌধুরী বলেন, সদরের চারটি পয়েন্টে রোহিঙ্গা নাগরিকরা অবস্থান করছে। স্থানীয় ইউপি সদস্য ও স্থানীয়দের ভাষ্যমতে এই সংখ্যা আনুমানিক ৫-৬ হাজার। তারা জিরো পয়েন্টে আশ্রয় নিয়েছে। ছোট ছোট সন্তান ও পরিবার পরিজন নিয়ে তারা মানবিক বিপর্যয়ে রয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে এমন সংকটে আমরাও পড়েছিলাম। তাই প্রত্যেককে রোহিঙ্গাদের সাথে মানবিক আচরণ করতে হবে।

Comments

Popular posts from this blog

অবিবাহিত মেয়ের বুকে দুধ, এই ভিডিওটি অবশ্যই একা একা দেখবেন !

টুইন টাওয়ারে ৯/১১ জঙ্গি হামলার ৫টি 'চমকপ্রদ' তথ্য

তৈরি করুন শীতের ভাপা পিঠা