টেকনাফ হবে ‘রোহিঙ্গা নগরী’!/
উখিয়া উপজেলার সদর বাজার থেকে শুরু করে টেকনাফের সাবরাং নয়াবাজার পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটারজুড়ে রাস্তার দুই পাশেই ক্ষুধার্ত মানুষ আর মানুষ। তবে এখানে অবস্থান নেওয়া লোকদের মাঝে অধিকাংশই পুরাতন রোহিঙ্গা। তাদের কারণে নতুন রোহিঙ্গারা অসহায় বলে জানা গেছে। উখিয়ায় রয়েছে ৫টি বড় বড় ক্যাম্প এর মধ্যে বেসরকারি হিসেবে তাজনির মারখোলা ক্যাম্পে দুই লাখ, হাকিরপাড়া ক্যাম্পে দেড় লাখ, জামতলী ক্যাম্পে ৪০ হাজার, বালুখালী ক্যাম্পে দুই লাখ, খাইনখালী উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০ হাজার, লাম্বার এশিয়া পাহাড়ে ১ লক্ষ রোহিঙ্গা রয়েছে।
টেকনাফে লোকসংখ্যা ২ লাখ ৮২ হাজার হলেও ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৪৮ হাজার ১০ জন। এখানে রোহিঙ্গাদের বড় আশ্রয়কেন্দ্র পুটিবুনিয়া (নতুন), লেদা (অনিবন্ধিত) ও নয়াপাড়া (সরকারি নিবন্ধিত) এই তিনটি। এই তিন কেন্দ্রে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা আড়াই লক্ষাধিক। ক্যাম্পগুলোতে লোকসংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এ ছাড়া পাহাড়ের ঢালে, সড়কের পাশে অনেক ছোট ছোট বস্তি গড়ে উঠেছে। আবার অনেকে তাদের পতিত ভিটায় বাঁশ, ত্রিপল, প্লাস্টিক দিয়ে লম্বা ঘর করে ভেতরে বেড়া দিয়ে আলাদা করে রোহিঙ্গাদের ভাড়া দিচ্ছেন। এসব দশ বাই দশ হাত ঘরের মাসিক ভাড়া সাতশ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত। আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরেও এসব ঘরে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা থাকছে। তুলনামূলক সচ্ছল রোহিঙ্গারা টেকনাফ শহরে বাড়ি ভাড়া নিচ্ছে। টেকনাফ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বললেন, শহরে এখন এমন কোনো বাড়ি পাবেন না, যেখানে রোহিঙ্গা নেই। অনেক রোহিঙ্গা কয়েক বছর ধরে বাড়ি ভাড়া করে আছে। নতুন আসা রোহিঙ্গারা এসব বাড়িতে আত্মীয়তা বা পরিচয় সূত্রে উঠছে। টেকনাফ শহরের এখন ভাড়াবাড়ির প্রধান গ্রাহক রোহিঙ্গারা। কোথাও বাড়ি ভাড়ার খবর পেলেই তারা সেখানে গিয়ে দরদাম করে উঠে পড়ছে। সব মিলিয়ে টেকনাফে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ ছাড়িয়েছে।
স্থানীয় লোকজনই এখন সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, এসব বাড়িতে রোহিঙ্গারা থাকছে অনেকটা মেসবাড়ির মতো করে। মেঝেতেই ঢালা বিছানা করে থাকছে। জাফর আলম নামের একজন থাকেন শহরের মৌলভীপাড়ায় দুই ঘরের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে। তারা এসেছেন মংডুর কাদির বিল এলাকা থেকে। এখানে তার সঙ্গে আরও একটি পরিবার থাকে। লোকসংখ্যা মোট ১৭ জন। পলিথিন ও বেড়ার এই বাসার একটি কক্ষ ভাড়া নিয়েছে মাসিক দেড় হাজার টাকায়। শহরের নাজিরপাড়ায় দূরসম্পর্কের এক চাচার বাড়িতে উঠেছেন রফিক। ৪ সেপ্টেম্বর এসেছেন তিনি চার সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে। এখন চেষ্টা করছেন আলাদা বাড়ি ভাড়া নেওয়ার। কিন্তু খালি বাসা পাচ্ছেন না। টেকনাফ শহরে এখন পথে বের হলেই পড়তে হয় সাহায্যপ্রার্থী রোহিঙ্গাদের সামনে। নতুন-পুরোনো রোহিঙ্গা মিশে গেছে। শহরের প্রধান সড়ক থেকে মহল্লার ভেতরের সড়ক, পাড়ার মোড়, বিপণিবিতান, নির্মাণাধীন ভবন, খাবার হোটেলের সামনে ভিড় করে থাকে তারা। নারীরা বোরকা পরে শিশু কোলে নিয়ে পথে পথে খাবার আর অর্থের সন্ধানে ঘুরছেন। অনেক শিশু-কিশোরও নেমেছে ভিক্ষায়। স্থানীয় বাসিন্দারা বিরক্ত, অতিষ্ঠ। টেকনাফ উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও প্রবীণ শিক্ষক জাহেদ হোসেন তো বলেই ফেললেন, সরকার মানবিকতা দেখাতে গিয়ে নিজের সন্তানদের কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে পরের সন্তানকে বুকে তুলে নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের জায়গা দিতে গিয়ে আমাদেরই এখন জায়গা নেই। তাদের জন্য পাহাড়, রাবার বাগান, সংরক্ষিত বন কেটে হাজার হাজার একর জায়গায় ক্যাম্প করা হচ্ছে। তাদের অনুপ্রবেশ চলছে। এখানেও বংশবৃদ্ধি হচ্ছে। মূল জনগণের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। একদিন এমন হবে যে সত্যি আমরা আর টেকনাফে থাকতে পারব না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের এখনই নির্দিষ্ট স্থানে না রাখলে পরে বড় ধরনের মাশুল দিতে হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক এ বিষয়ে বলেন রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্টে ঢুকছে।
রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে আশ্রয় ও বাসা ভাড়া না দিয়ে তাদের জন্য স্থাপিত ক্যাম্পে পাঠানোর জন্য প্রতিদিন এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও টেকনাফের রাস্তাঘাট ও খোলা জায়গায় প্রচুর রোহিঙ্গা দেখা যাচ্ছে। অনেকে বাসা ভাড়া করে আছে বলেও শুনেছি। এদিকে গত ২৫ আগস্ট থেকে এই পর্যন্ত ৪ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমার সরকার জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রাম এখন জনশূন্য। বিবিসির খবরে জানা যায়, রোহিঙ্গারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম মিয়ানমারে বসবাস করছে। তবে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি। সাম্প্রতিক এই সংকটের কারণে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক নিন্দার সম্মুখীন হয়েছে। এদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তা-বে রাখাইন রাজ্য ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা। এর মধ্যে নারী এবং শিশুর সংখ্যাই বেশি। রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরসহ খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নিপীড়নে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার রোহিঙ্গা মারা গেছে।
বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে। সাম্প্রতিক ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের লক্ষ্যে সেনা অভিযান শুরুর কয়েকদিনের মাথায় ২৪টি পুলিশ চেকপোস্টে বিদ্রোহী রোহিঙ্গাদের সমন্বিত হামলায় অন্তত ১০৪ জন নিহত হওয়ার কথা জানিয়ে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান জোরদার করে সরকার। এরপর থেকেই মিলতে থাকে বেসামরিক নিধনযজ্ঞের আলামত। পাহাড় বেয়ে ভেসে আসতে শুরু করে বিস্ফোরণ আর গুলির শব্দ। পুড়িয়ে দেওয়া গ্রামগুলো থেকে আগুনের ধোঁয়া এসে মিশতে থাকে মৌসুমী বাতাসে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে শূন্যে ছুড়তে থাকে সেনারা। কখনও কখনও কেটে ফেলা হয় তাদের গলা। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় মানুষকে। আহত শরণার্থী হয়ে তারা ছুটতে থাকে বাংলাদেশ সীমান্তে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ৪ লাখ ১২ হাজার ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
Comments