পাহাড়ে পাহাড়ে রোহিঙ্গা ঢল

পাহাড়ে পাহাড়ে রোহিঙ্গা ঢল
মাহমুদ আজহার, রফিকুল ইসলাম রনি ও ফারুক তাহের, তুমব্রু ও কুতুপালং থেকে
উখিয়ার কুতুপালং থেকে টেকনাফের মুছনী পর্যন্ত ছোট-বড় শতাধিক পাহাড়ে ঢল নেমেছে রোহিঙ্গার। এরই মধ্যে বন বিভাগের অন্তত ২৫ হাজার একর ভূমিতে আশ্রয়শিবির গেড়েছে তারা।
যদিও কুতুপালং ও বালুখালীতে বন বিভাগের বরাদ্দ ২ হাজার একর। বন বিভাগের অধিকাংশ ভূমিই পাহাড়ি। এখনো আরাকান থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের স্রোত থামেনি। প্রতিদিনই বেশ কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘যেভাবে তারা আসতে শুরু করেছে, তাতে শিগগিরই ৩০-৪০ হাজার একর বনভূমিতে রোহিঙ্গাদের তাঁবু টানানো হতে পারে। এরই মধ্যে আশ্রয় নেওয়া পাহাড়গুলো বেশ খোঁড়া হয়েছে। নিধন করা হয়েছে গাছপালা ও লতাগুল্ম। যেভাবে বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে তাতে পাহাড়ধসের শঙ্কাও রয়েছে। কিছু দিন আগে পাহাড়ধসে তিন রোহিঙ্গার মৃত্যুও হয়েছে। ’ গতকাল বান্দরবানের তুমব্রু এলাকার তিনটি পাহাড় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, তিনটি পাহাড়ই ন্যাড়া করে ফেলা হয়েছে। সব গাছপালা কেটে তাঁবু টানানো হয়েছে। এখনো পাহাড় কেটে বসতি তৈরির কাজ চলছে। আঞ্জুমানপাড়া, নাইক্ষ্যংছড়ির বড় ছনখোলা, বাইশারি, আশার তলীসহ বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে বাঁশ কেটে ত্রিপল টানিয়ে তাঁবু তৈরি করা হয়েছে। পাহাড়ের টিলায়ও তাঁবু টানাতে দেখা গেছে। দুপুরে একটি পাহাড়ে কোদাল দিয়ে মাটি কাটছিলেন সুলাইমান নামে এক মধ্যবয়সী লোক। তিনি বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন মিয়ানমারের মংডুর লেমশি এলাকা থেকে। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘কুতুপালংয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কোথাও আশ্রয় পাইনি। তাই তুমব্রু পাহাড়ে চলে এসেছি। ’
উখিয়া থেকে টেকনাফ সড়কের কুতুপালং, বালুখালী ও পালংখালী এলাকাজুড়েই পাহাড় আর পাহাড়। এসব এলাকায় রোহিঙ্গাদের ঘনবসতি। প্রাকৃতিক কারণে এসব পাহাড় বালুময় ও ঝুরঝুরে। অতি বৃষ্টিপাত হলে স্বাভাবিক কারণেও পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। তবে অপরিকল্পতভাবে পাহাড় কেটে এখন আশ্রয়শিবির নির্মাণ করা হয়েছে। এতে সামান্য বৃষ্টিপাত হলে পাহাড়ধসের শঙ্কা রয়েছে। গত তিন দিন ধরে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। সূত্রমতে, উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী, টেকনাফের হ্নীলা, হোয়াইক্যং, লেদা, মুছনী, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির চাকডালা, তুমব্রু, জলপাইতলী, কলাবাগানসহ বিস্তৃত পাহাড় ও বনভূমির বাঁশ-গাছ উজাড় করা হচ্ছে। আগের থেকে ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বসবাস থাকা সত্ত্বেও টেকনাফ, উখিয়ার পাহাড়ে গত ২৫ দিনে আশ্রয় নিয়েছে আরও ৮ থেকে ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর সাময়িক আশ্রয় কেন্দ্র তথা বাঁশ ও পলিথিন-ত্রিপলের তাঁবু তৈরিতে প্রতিদিন প্রয়োজন হচ্ছে লাখ লাখ বাঁশ ও গাছ। এ বাঁশ-গাছের জোগান দিতে গিয়েই উজাড় হচ্ছে পাহাড়ি বনভূমি, লতাগুল্ম। চড়া দামে বিক্রি করার সুযোগে একটি চক্র সরকার ঘোষিত অভয়ারণ্য থেকেও বাঁশ-গাছ কেটে ফেলছে। কক্সবাজার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (দক্ষিণ) মোহাম্মদ আলী কবীর গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘বিস্তীর্ণ পাহাড়ি বনভূমিতে রোহিঙ্গারা তাঁবু গেড়েছে। তা অস্বীকার করার কিছু নেই। গতকালও এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা হয়েছে। ২ হাজার একর বনভূমি কিন্তু কম নয়। এতেই আশা করি সবাইকে ঠাঁই দেওয়া সম্ভব হবে। এজন্য একটি শৃঙ্খলায় নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। বিচ্ছিন্নভাবে কাউকে বসবাস করতে দেওয়া হবে না। সবাইকে সরকার নির্ধারিত জায়গায় ফিরতে হবে। নইলে রোহিঙ্গাদের ত্রাণসহ সব সুবিধা বন্ধ হবে। ’
জানা যায়, মহাসড়কের পাশে পাহাড়গুলোয় কাউকে তাঁবু গাড়তে দেওয়া হচ্ছে না। যারাই সেখানে তাঁবু নির্মাণের চেষ্টা করে তা ভেঙে দেওয়া হচ্ছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তবে এসব নতুন রোহিঙ্গাকে বলা হচ্ছে কুতুপালং ও বালুখালীতে সরকার নির্ধারিত স্থানে চলে যেতে। তবে কিছু টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন পাহাড়ে আশ্রয় দেওয়ার কথা বলে একটি দালাল চক্রও রোহিঙ্গাদের প্রতারণা করছে। তাদের ধরতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমও চলছে। এরই মধ্যে কয়েকজন বাঙালি দালালকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোর অধিকাংশেই কোনো ধরনের পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়নি। নতুন করে আসা রোহিঙ্গারাও খোলা আকাশের নিচেই মলমূত্র ত্যাগ করছে। এতে এখানকার স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট হতে শুরু করেছে। শিগগিরই দূষণ রোধের কোনো উদ্যোগ না নিলে ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের সরদার শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এরই মধ্যে বিভিন্ন পাহাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যে কোনোভাবে তাদের সরকার নির্ধারিত বনভূমিতে ফিরিয়ে আনতে হবে। নইলে পাহাড় ও গাছপালা যেভাবে কাটা হচ্ছে, যে কোনো সময় ভয়াবহ ধস নামতে পারে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে— এটাই স্বাভাবিক। ’ বন্যহাতির আক্রমণে দুই রোহিঙ্গার মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখানে বন্যহাতির দোষ দিয়ে লাভ নেই। গভীর অরণ্যে গিয়ে হাতির বসবাসের জায়গায় কেউ বসতি গড়তে চাইলে আক্রমণ করতেই পারে। ’
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু জানান, ‘পাহাড়ি ভূমিতে রয়েছে সামাজিক বনায়নের গাছ। শুধু তাই নয়, বালুখালী বনভূমি হচ্ছে বন্যহাতির আবাসস্থল, পশুপাখির অভয়ারণ্য। এখন প্রতিদিনই কাটা হচ্ছে লাখ লাখ বাঁশ, গাছ, লতাগুল্ম। ন্যাড়া হয়ে যাচ্ছে পাহাড়। এতে যে কোনো সময় পাহাড়ধস হতে পারে। ’
বন্যহাতির আক্রমণে শিশুসহ দুই রোহিঙ্গা নিহত : কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় বন্যহাতির আক্রমণে বাবা-ছেলের মৃত্যু হয়েছে। রবিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে কুতুপালং মধুর ছরা গুলশান পাহাড়ে মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটে। এ সময় আরও তিন  রোহিঙ্গা নারী আহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন শামসুল আলম (৫৫) ও তার দুই বছর বয়সী ছেলে সৈয়দুল আমিন। শামসুল আলম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বলিবাজার ফকিরের ডেইল এলাকার নুরুল আলমের ছেলে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে উখিয়া টিভি রিলে কেন্দ্রের পাশে অবস্থান নিয়েছিলেন তারা। শনিবার সকালে তাদের বাড়িঘর অন্যত্রে সরিয়ে নেওয়ার জন্য উপজেলা প্রশাসন মাইকিং করলে তারা সেখানে চলে যান। রাতে বন্যহাতির কবলে পড়ে তারা নিহত হন। উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) মো. কায়কিসলু জানান, ‘রবিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে হঠাৎ হাতির পাল আক্রমণ করে। ওখানে সম্প্রতি ঘর করে বাস করা রোহিঙ্গারা হাতির পাল তাড়াতে চেষ্টা করে। এ সময় হাতি লোকজনের ওপর আক্রমণ করে বসে। সামনে পড়ে যাওয়ায় শামসুল আলম ও তার ছেলেকে শুঁড়ে পেঁচিয়ে আছাড় মারে উত্তেজিত হাতি। এ ঘটনায় আরও কয়েকজন নারী আহত হয়েছেন বলে খবর পেয়েছি। তাদের কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ’

Comments

Popular posts from this blog

অবিবাহিত মেয়ের বুকে দুধ, এই ভিডিওটি অবশ্যই একা একা দেখবেন !

তৈরি করুন শীতের ভাপা পিঠা

টুইন টাওয়ারে ৯/১১ জঙ্গি হামলার ৫টি 'চমকপ্রদ' তথ্য