মশিউর জারিফ-
মিয়ানমারে জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে লাখো রোহিঙ্গা। এমনকি অনেক নারীই এদেশে প্রবেশের পর জন্ম দিয়েছে শিশু। জন্ম নেওয়া এসব শিশুদের নিয়ে অনেকের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নানা প্রশ্ন। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুরা কি নাগরিকত্ব পাবে?
এদেশে জন্ম নেওয়া কয়েকজন রোহিঙ্গা শিশুর বাবা-মায়েদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘তারা চান এখানে জন্ম নেয়া শিশুরা যেন বাংলাদেশেরই নাগরিক হয়।’
এদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সন্তান এদেশে জন্ম নিলেও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাবে না রোহিঙ্গা শিশুরা। সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান উখিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মঈন উদ্দিন।
জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে রেকর্ডসংখ্যাক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের কারণে আপাতত: জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।
সরকারি হিসাবে গত ২৫ দিনে উখিয়া এবং টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে জন্ম গ্রহণ করেছে প্রায় ২শ’ রোহিঙ্গা শিশু। আর সন্তান জন্মদানের অপেক্ষায় আছেন প্রায় ১৭ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নারী।
বাংলাদেশে জন্ম নেয়া এসব রোহিঙ্গা শিশুদের নাগরিকত্ব নিয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার কথা জানালেন উখিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মঈন উদ্দিন।
তিনি বলেন, নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের জন্ম নিবন্ধন হবে। কিন্তু জন্ম নিবন্ধনের সনদপত্রে তারা যে মিয়ানমারের নাগরিক সে বিষয়ে উল্লেখ থাকবে।
এদিকে সর্বশেষ গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন, ২০১৬-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ আইন অনুসারে সাতটি মাধ্যমে অর্জন করা যাবে বাংলাদেশী নাগরিকত্ব। সেগুলো হলো— ১. বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ বা বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস বা জাহাজ কিংবা বিমানে জন্মগ্রহণ ২. বাংলাদেশী নাগরিকদের সন্তান ও তাদের সন্তান ৩. দ্বৈত নাগরিক ৪. অর্জিত নাগরিকত্ব ৫. বৈবাহিক সূত্র ৬. নতুন সংযুক্ত ভূখণ্ডের অধিবাসী ও বাংলাদেশের স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ চেয়ে আবেদন করা ব্যক্তি এবং ৭. সম্মানসূচক নাগরিকত্ব।
আইনটিতে ভুয়া নাগরিক প্রমাণিত হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে মামলা করা যাবে। এতে সর্বনিম্ন পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে খসড়া এ আইনটিতে বলা হয়েছে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তি জন্মসূত্রে বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেন, যদি তার পিতা বা মাতা এ আইন বলবত্ হওয়ার তারিখে বা এর পরে অথবা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে এ আইন বলবত্ হওয়ার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হন বা থাকেন।
বাংলাদেশের নাগরিক হবার/থাকার যোগ্য থাকবে না যাদের-
১. যদি সেই ব্যক্তি দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণের ক্ষেত্র ব্যতীত কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আনুগত্য প্রকাশ করে।
২. বিদেশী রাষ্ট্রের কোনো বাহিনীতে যোগদান করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা অন্য কোনোভাবে উক্ত বাহিনীকে সহায়তা করে থাকে এবং এ আইন বলবত্ হওয়ার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস না করে।
৩. এমন কোনো দেশের নাগরিক বা অধিবাসী, যে রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল বা আছে।
৪. বাংলাদেশে বেআইনি অভিবাসী হিসেবে বসবাস করে বা করে থাকে।
এদিকে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে বসবাসরত এসব রোহিঙ্গারা বেআইনি অভিবাসী হিসেবে গণ্য হয়।
উপরের ৪ নম্বর পয়েন্টে উল্লিখিত আছে, বাংলাদেশে বেআইনি অভিবাসী হিসেবে যারা বসবাস করে থাকে, তাদের বাংলাদেশের নাগরিক হবার/থাকার যোগ্যতা নেই।
অপরদিকে বাংলাদেশ সরকার ২০০৯-১৫ সাল পর্যন্ত মোট ৩৭ হাজার ৫৪৪ জন বিদেশীকে বাংলাদেশী নাগরিকত্ব দিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময়ের কারণে ৩৭ হাজার ৫৩৫ জনকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। এর বিপরীতে ছিটমহল বিনিময় করে ১৪ হাজার ৮৬৪ জন ও ব্যক্তিগত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৫২৬ জন বাংলাদেশী নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। এছাড়া ২০১৪ সালে বৈবাহিক সূত্রে নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে পাঁচজনকে। বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ নাগরিকত্ব দিয়েছে দুজনকে। এরা হলেন নিউজিল্যান্ডের ফাদার আরতুরো ও ইতালিয়ান নাগরিক এড্রিক সাজিসন বেকার। সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে ব্রিটিশ নাগরিক ভেলেরি এ টেইলর ও ইতালিয়ান নাগরিক ফাদার মারিনো রিগানকে। এ সময় ৯ হাজার ১৬ জন প্রবাসী বাংলাদেশীকে দ্বৈত নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ আগস্ট দিনগত রাতে রাখাইনে যখন পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এর জেরে ‘অভিযানের’ নামে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। ফলে লাখ লাখ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চলে আসছেন।
জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইএমও) বলছে, সহিংসতার শিকার হয়ে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় সোয়া চার লাখ। তবে বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে। সহিংসতায় প্রাণ গেছে তিন হাজারের বেশি মানুষের। বেসরকারিভাবে এই সংখ্যা দশ হাজার পার করেছে মধ্য সেপ্টেম্বরেই।
Comments