রোহিঙ্গাদের প্রতি এ নির্মমতার শেষ কোথায়?


রোহিঙ্গাদের প্রতি এ নির্মমতার শেষ কোথায়?
রোহিঙ্গাদের প্রতি নির্মমতার খবর এসেছে আবার। অশান্ত এবং সহিংস বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গা জনগণের রক্তে লাল হয়েছে নাফ নদীর পানি। মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সীমান্ত চৌকিতে তথাকথিত রোহিঙ্গা জঙ্গিদের হামলার জের ধরে নিরাপত্তা বাহিনী নিরীহ, নিরস্ত্র রোহিঙ্গা অধিবাসীদের ওপর বেপরোয়া গুলি বর্ষণ করে। এতে কমপক্ষে ৮৯ জন নিহত হয়েছে। মায়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং কার্যত সব কর্তৃত্বের মালিক অং সাং সুচির দপ্তর ২৫ আগস্ট জানিয়েছে যে, নিহতদের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১২। মূলত সাধারণ মানুষের মৃত্যুকে আইনানুগতা দেওয়ার জন্য ঐ ১২ জন নিরাপত্তা বাহিনীর নিহতের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়। সাধারণ মানুষসহ অন্য যারা নিহত হয়েছে তাদের সংখ্যা মায়ানমারের সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী ৭৭ জন। তারা সকলেই ‘জঙ্গি’ বলে দাবি করা হয়েছে। এখন দক্ষিণ এশিয়ার তথা উপমহাদেশের যেখানেই যেকোনো ঘটনা ঘটুক না কেন দায় চাপানো হয় জঙ্গিদের ওপরে। জঙ্গিদের ওপরে দায় চাপালে আর কারো কোনো মানবিক ও রাষ্ট্রিক দায়িত্ব থাকে না—ভাবখানা এমন। মায়ানমারের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।

ইতিহাস সাক্ষী যে, ১৯৪৮ সালে স্বাধীন বার্মা রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর থেকে অসংখ্য বার রোহিঙ্গা মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে। বারবার তারা বর্মী তথা মায়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর নির্মমতার শিকার হয়েছে। দীর্ঘ অতীতের কথা না হয় নাই বললাম। ১৯৯২ থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৪ বার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক হামলা হয়েছে। আর প্রতিবারই তারা জীবন বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করেছে। প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে এসেছিল ২ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা। ১৯৯৩-৯৭ সালে তথাকথিত কূটনৈতিক প্রয়াসে ফিরে যায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা অধিবাসী। ২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক হানাহানির জের ধরে আবার রোহিঙ্গারা নাফ নদী পাড়ি দেয়। ২০১৬ সালে সীমান্তের চৌকিতে কথিত হামলার পর এসেছে ৮৭ হাজার। এখন ২০১৭ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহে অগণিত রোহিঙ্গা নির্মম সহিংসতার পর বাড়ি-ঘর ছেড়ে সীমান্তের দিকে ছুটছেন। বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গাদের জন্য আর এক নির্মমতা অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশ জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ একটি দেশ। আমাদের অর্থনৈতিক ভিতও অতটা শক্ত নয়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মানবিকতা ও আতিথেয়তার প্রমাণ রয়েছে ইতিহাস জুড়ে।

পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ আছে কিনা সন্দেহ যেখানে নিজ সরকার তাদের জনগণকে পরবাসী মনে করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে জনপদে রোহিঙ্গাদের বসবাস সে ভূমিতে তাদের বসবাসের অধিকার নেই। তাদের ভোটাধিকার নেই। চলাফেরার স্বাধীনতা নেই। এমনকি তাদের স্বইচ্ছায় সন্তান গ্রহণের অধিকারটুকুও নেই। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রতি পৃথিবীর তাবত্ মানুষের মানবিক বিশ্বাস রয়েছে। কারণ তারা বলেন, ‘অহিংসা পরম ধর্ম, জীব হত্যা মহাপাপ’। অথচ সে বাণী আজ সে ধর্মের তথাকথিত অনুসারীদের দ্বারাই কলঙ্কিত। সব দোষ নন্দ ঘোষ। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে মুসলমানরা রয়েছে তাদের প্রতি সর্বত্রই জঙ্গিত্ব আরোপ করা হচ্ছে। এ ধরনের সাধারণ দোষারোপকে আন্তর্জাতিক ভাষ্যকারগণ একপেশে, অন্যায় ও অমানবিক মনে করেন। সত্য বটে যে, বৃহত্তর মায়ানমারে জাতিগত সংঘাত স্বাধীনতার পর থেকে দেশটিকে গৃহযুদ্ধরত রেখেছে। শান, কারাণ ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর মতো রাখাইন প্রদেশও একটি সংগ্রামশীল জনপদ। রোহিঙ্গারা যে দেশটিকে বলে ‘আরাকান’, তার বিরোধীরা বলে ‘রাখাইন’ প্রদেশ। রাখাইনরা বৌদ্ধ এবং বর্মী নৃগোষ্ঠীর লোক হওয়ার কারণে সব সময়ই কেন্দ্রীয় সরকারের মদদ পেয়ে আসছে। সেখানে প্রথমত, রাখাইন রোহিঙ্গা স্বার্থের দ্বন্দ্ব অবশেষে সামরিক সরকারের শক্তি প্রয়োগের সুযোগ করে দেয়। তেমনি একটি দ্বন্দ্বের জের ধরে ঘটে গত সপ্তাহের ঘটনা।

গত ২৪ ও ২৫ আগষ্ট বাংলাদেশ-সংলগ্ন মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলীয় এই রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে মুসলিম বিদ্রোহীদের সংঘর্ষ ঘটে বলে মায়ানমারের সরকারি ভাষ্যে বলা হয়। উল্লেখ্য যে, রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিতাড়নের সূত্র হিসেবে প্রায়ই উল্লেখিত রাখাইন বা মায়ানমারের সেনাবাহিনী এমনতর ঘটনা ঘটায় এবং সেই অজুহাতে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়ন শুরু হয়। মায়ানমারের সরকারি ভাষ্যে আরো বলা হয়, কমপক্ষে ২০টি বাংলাদেশ-সংলগ্ন সীমান্ত চৌকিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এ হামলার ফলে গত কয়েক মাস আগের নিপীড়নের ক্ষত শুকোতে না শুকোতেই আবার এ ধরনের হামলা হলো। এই হামলার ফলে সীমান্তে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা আবারও বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে অথবা নাফ নদীতে ভাসমান রয়েছে অথবা বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড-বিজিবি এর হাতে আটক রয়েছে। বাংলাদেশে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ মায়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য তাদের সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ জনগোষ্ঠীর  সঙ্গে রোহিঙ্গাদের আত্মিক, ভাষাগত এবং নৃতাত্ত্বিক মিল রয়েছে।  যেহেতু তারা বাংলায় কথা বলে সেকারণে সরকার তাদের প্রতি একটু সহানুভূতি দেখাতে পারে। ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সংবিধানে কঠিন করে ধর্মনিরপেক্ষতা অনুসরণের তাগিদ রয়েছে। ভারত নেহরু আমল থেকেই ‘পঞ্চশীলা নীতি’র অনুসারী বলে এই ভারতই আবার যখন যেখানে ভারতীয় বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠী বিপাকে এবং বিপদে পড়েছে তখন তারা দূর সমুদ্র পাড়ি দিয়েও তাদের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ও সহযোগিতা  করেছে। সম্ভবত ২০০০ সালের প্রথম দিকে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ ফিজিতে হিন্দু জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়। তখন ভারতীয় নৌ বাহিনীর একটি ব্রিগেড ফিজির হিন্দু জনগোষ্ঠীর সমর্থনে সেখানে গমন করে। একই ঘটনা ঘটে যখন আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের দেশগুলোতে ভারত উদ্ভূত জনগোষ্ঠী  বাণিজ্যিক ও পারিপার্শ্বিক সংকট মোকাবিলা করে। কয়েক বছর আগে লোহিত সাগরের মুখে অবস্থিত এডেন বন্দরে ভারতীয় জনগোষ্ঠী বিপন্ন বোধ করলে ভারত সেখানে রণতরী পাঠায়। সুতরাং, বাড়ির পাশে পড়শিরা যখন বিপদগ্রস্ত তখন বাংলাদেশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে না।

নিজ দেশের নাগরিক সাধারণ অথবা বংশোদ্ভূত অথবা বংশ-পরম্পরায় যুক্ত জনগোষ্ঠী বিপদগ্রস্ত হলে বিশ্বের অসংখ্য দেশকে আমরা দেখেছি স্বস্বার্থে এগিয়ে  আসতে। রাশিয়া এই পরম্পরার দোহাই দিয়ে ক্রিমিয়া দখল করেছে। এখন ইউক্রেনের সীমান্তে সশস্ত্র হস্তক্ষেপের পাঁয়তারা করছে। পৃথিবীর অনেক দেশ তাদের ভ্রাতৃপ্রতীম জনগণকে রক্ষা করার জন্য অনেক রক্ষাকবচ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশস্থ মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়েছে সরকার। যখন বাংলাদেশের ওপর বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় ঠেলে দেওয়া হয়েছে এবং গোটা বিশ্বের প্রতিবাদের মুখেও ‘মগের মুলুকের’ কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি তখন ডেকে পাঠানোর মৃদু প্রতিবাদে কাজ হবে না। যেহেতু বাংলাদেশ আরাকান বা রাখাইন স্টেটের সবচেয়ে নিকটবর্তী দেশ এবং রোহিঙ্গারা নিপীড়নের শিকার হলেই বাংলাদেশে প্রবেশ করে সেহেতু প্রতিবেশির দায়, মানবিক বিপর্যয় এবং আন্তর্জাতিক রীতি রেওয়াজ অস্বীকার করার কারণে বাংলাদেশ বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করতে পারে। ইতিমধ্যে জাতিসংঘ রোহিঙ্গা প্রশ্নে মানবিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে। গোটা বিশ্বের মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বশীল ওআইসি মহাসচিব সেদিন বাংলাদেশস্থ রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে গেলেন। তারা অবশ্য আহা উহু ছাড়া তেমন কিছু করছেন না। কিছু করার দায় নিয়েছিল আনান কমিশন। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে প্রধান করে রোহিঙ্গাদের বিষয় সুপারিশ প্রণয়নের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়। অনেকটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার নৈতিক চাপে গঠিত এ কমিশন ২৮ দফা সুপারিশ প্রণয়ন করে। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভোটাধিকার প্রদান এবং তাদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, কফি আনানের এই সুপারিশ প্রণয়নের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রোহিঙ্গাদের দ্বারা তথাকথিত সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটলো। আন্তর্জাতিক রাজনীতির কুশীলবরা বিশ্বাস করেন যে, এর পেছনে মায়ানমার রাষ্ট্রের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র রয়েছে যাতে আনান কমিশনের দায়ভার থেকে মায়ানমার যথার্থই মুক্ত হতে পারে। উল্লেখ্য যে, নোবেলজয়ী তথাকথিত শান্তির বার্তাবাহী অং সাং সুচি এখন মায়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। মায়ানমারের সামরিক সরকারের মতো তিনিও অভিন্ন ভাষা, কৌশল এবং কার্যক্রমে দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে অব্যাহত অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিলেন বলা চলে! এ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি, স্থিতি এবং নিরাপত্তার জন্য রোহিঙ্গা ইস্যুর রাজনৈতিক সমাধান অপরিহার্য।

n লেখক :প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

mal55ju@yahoo.com

Comments

Popular posts from this blog

অবিবাহিত মেয়ের বুকে দুধ, এই ভিডিওটি অবশ্যই একা একা দেখবেন !

তৈরি করুন শীতের ভাপা পিঠা

টুইন টাওয়ারে ৯/১১ জঙ্গি হামলার ৫টি 'চমকপ্রদ' তথ্য