ডোনাল্ড ট্রাম্প যা করছেন তা ভয়ঙ্কর
আমরা যা ভেবেছিলাম ডোনাল্ড ট্রাম্প আসলে তাই-ই। জন্মবাদ বা জন্মের ভিত্তিতে মানুষের মাঝে বিভাজন রীতির বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান শুরুর পর ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ডেভিড ডিউকের মতামতের নিন্দা করতে ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেন। অবশেষে জনগণের আক্রোশ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বর্ণবাদী কথাবার্তার বিরুদ্ধে যে বিবৃতি দেন তা রুটিনমাফিক ও দায়সারা গোছের। যারা তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন, তাদেরকেও তিনি সহিংসতার জন্য দোষারোপ করেছেন। ট্রাম্প গত কয়েকদিনে প্রমাণ করেছেন তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবেও একই ব্যক্তি। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ও পরের মধ্যে কোনো তফাত্ নেই এবং তিনি একজন নেতার ঠিক বিপরীত চরিত্রের মানুষ। এই ধরনের ব্যক্তি আমেরিকার মতো দেশের কল্যাণের জন্য বিপজ্জনক।
গত মঙ্গলবার ট্রাম্প টাওয়ারে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি যে মন্তব্য করেন তাতে দেশের জাতিগত ইতিহাস ও এই দেশের বাস্তবতার নিরিখে শুধু গোঁড়ামিই প্রকাশ পায়নি, বরং নৈতিকভাবে অযৌক্তিক এক ব্যক্তিগত অবস্থানের প্রতি তার ইচ্ছের প্রতিফলনও ঘটেছে। ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিলিতে নব্য নািসবাদী ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা শ্বেতাঙ্গবাদী নেতা রবার্ট ই লি’র মূর্তি অপসারণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। একই সঙ্গে শ্বেতাঙ্গবাদবিরোধীরাও আয়োজন করে বিক্ষোভের। এতে সৃষ্ট সহিংসতায় একজন নারী মারা যান। এই ঘটনায় অনেক পীড়াপীড়ির পরও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের দোষারোপ করতে তার তিন দিন লেগে যায়। এর একদিন পর ট্রাম্প তার আসল অবস্থানে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বলেন যে, এই ঘটনায় উভয় পক্ষের অবস্থানই ভুল। যারা এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তারা মিডিয়ার ভুয়া খবর দ্বারা প্রভাবিত। তার ভাষায়, ‘ আমি তাদের ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম, আপনাদের চেয়েও ঘনিষ্ঠভাবে। আপনাদের এক পাশে একটি গ্রুপ ছিল যারা খারাপ। অন্য পাশের গ্রুপটিও ছিল মন্দ ও সহিংস। কেউ বলতে চায় না। তবে আমি এখন বলব সঠিক কথাটা।’ এরপর তিনি রিপোর্টারদের উদ্দেশে বললেন, ‘আমি মনে করি, উভয় পক্ষেরই দোষ আছে। এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আপনাদেরও এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না।’ আবার তিনি বলে ওঠেন, ‘ আমি শুধু আপনাদের বলতে পারি, এই গল্পে দুটি পক্ষ আছে। আমার মনে হয় যা ঘটেছে তা আমাদের দেশের জন্য একটি ভয়ঙ্কর মুহূর্ত, একটি ভয়ঙ্কর মুহূর্ত। কিন্তু এতে দুটি পক্ষ আছে।’
এই অভিমতটি বাস্তবিকভাবেই অস্পষ্ট। এক পক্ষ মাত্র একটি বিশ্বাসগত পদ্ধতির সাথে সম্পৃক্ত। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীদের ওপর তারা একটি দ্রুতগতির গাড়ি চালিয়ে দেয়। এই ঘটনায় মারা যান ঐ নারী। আহত হন এক ডজনেরও বেশি লোক। শনিবার শার্লটসভিলিতে শুধু এক দল তাদের জাতি বা ধর্মের কারণে অন্য তথাকথিত নিকৃষ্ট লোকদের ওপর তাদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। শনিবার মাত্র এক দল লোক এক খুনি স্বৈরশাসকের প্রশংসা করেছে যে, ব্যক্তি হত্যা করেছে লাখ লাখ মানুষকে।
ট্রাম্প এই কথা জানেন। তিনি অত বোকা নন। তিনি ইতিহাসের সাথেও অপরিচিত নন। সুতরাং তিনি এটাও জানেন যে, তিনি যা করছেন তা ভয়ঙ্কর। এটা নৈতিক রিলেটিভিজম বা সম্বন্ধবাদের দিক থেকেও ভুল। কেননা এটার অর্থ হলো— তিনি নালিশ ও ইতিহাস পুনর্লিখনের ক্ষমতা রাখেন। কিংবা বর্তমান আদর্শ তথা একটি বিপরীত মতাদর্শের মধ্যে জুতসইভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ধারণ করতে পারাটা ভালোমতো উপলদ্ধি করেন যদিও তা ঘৃণা ছড়াতেই অভ্যস্ত।
শার্লটসভিলিতে শ্বেতাঙ্গবাদী নেতা রবার্ট ই লির মূর্তিটি অপসারণের বিষয়ে ট্রাম্পের মন্তব্যটিও ভেবে দেখার মতো। তিনি বলেন, ‘ সুতরাং এই সপ্তাহটি রবার্ট ই লি’র। আমি লক্ষ্য করলাম স্টোনওয়াল জ্যাকসন আসছেন এরপরই। পরের সপ্তাহে যদি জর্জ ওয়াশিংটন আসেন তাতে বিস্মিত হবো না এবং এর পরের সপ্তাহে টমাস জেফারসন আসছেন কি? আপনারা জানেন, আপনারা সবাই জানেন, নিজেদের জিজ্ঞেস করতে পারেন এটা কোথায় গিয়ে থামবে?’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্টের সাথে নিজ দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী একজন আঞ্চলিক নেতা ও কনফেডারেট জেনারেলের তুলনা চলতে পারে না। এটা বুদ্ধিবৃত্তিক সততার মধ্যে পড়ে না। ট্রাম্প এটা ভালো করেই জানেন। আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের হাই প্রোফাইল নেতা ডেভিড ডিউক। তিনি এক টুইটবার্তায় লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার সততা ও সাহসের জন্য। শার্লটসভিলির ঘটনায় সত্য বলার জন্য এবং বামপন্থি সন্ত্রাসীদের দোষারোপের জন্য।’ ট্রাম্প রবার্ট ই লি’কে জর্জ ওয়াশিংটনের সাথে তুলনার জন্যও তিনি তার প্রশংসা করেন।
ডেভিড ডিউক যখন আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখন আপনার জীবনে আপনি কী করেছেন তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় এসেছে। আপনি নির্বাচনী প্রচারণায় কী করেছেন তাও পরীক্ষা করে দেখতে হবে। প্রেসিডেন্ট দুই পক্ষকেই দোষারোপ করে বলতে চাইছেন শ্বেতাঙ্গবাদ বিরোধীরা বামপন্থিদের মতোই অসহিষ্ণু। এতে তারা অবশ্যই ক্রোধান্বিত হবে।
ট্রাম্প গত কয়েকদিনে যা করেছেন বিশেষ করে গত মঙ্গলবার ট্রাম্প টাওয়ারে যা বলেছেন তা নিশ্চিতভাবে শার্লটসভিলিতে প্রতিবাদকারী ঘৃণাত্মক কর্মীদের জাগরণ ঘটাবে। তারা ট্রাম্প থেকে তাদের দোষের দ্বিধাবিভক্ততাকে দেখবে নিজেদের বিজয় হিসেবে। ফলে তারা আমাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা ও আমাদের মানবতার অন্ধকারতম দিকগুলোকে আবার সামনে আনার প্রচেষ্টাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। এর ফলাফল হবে ট্রাম্পের দ্বারা রাজনৈতিক ব্যর্থতার চেয়েও বেশি কিছু। এটি নৈতিক নেতৃত্বেরও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
এটা অসম্ভব, হতে দেওয়া যায় না। ট্রাম্পের গেল দু’বছরের কর্মকাণ্ডের উপসংহারে বলা যেতে পারে, তিনি জাতি, লিঙ্গ ও জাতিগত ঐতিহ্যের বিষয়গুলোতে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু দেশের মধ্যকার প্রকৃত অবস্থাটি তার বিপরীত। অনেক প্রমাণ রয়েছে যে, তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবেই বলছেন এসব কথা। তিনি এমন নীরবতাপূর্ণ নৈতিক প্রশ্ন করার বিষয়গুলো তুলছেন যা স্পষ্ট হওয়া দরকার। তিনি এসব কেন করছেন? রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের যা করা উচিত এটা তার ঠিক বিপরীত। এই দেশের নাগরিক হিসেবে কী করা উচিত এটা তারও বিপরীত। আসলে ট্রাম্প যা করছেন তা আমাদের রাজনীতি ও নৈতিক অবস্থান থেকে ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জনক। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের মার্জনা করতে হলে আমাদের অতীত দশকগুলোর দিকে তাকাতে হবে। এই সময় আমাদের পরস্পরের মধ্যে গড়ে ওঠে বোঝাপড়া। ফলে সব মানুষের জন্য একটি মুক্ত ও তুলনামূলকভাবে ভালো দেশের অগ্রগতি সম্ভব হয়। তা আবার করতে হলে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে রাজনৈতিক বিন্দু আঁকার প্রবণতা বাদ দিতে হবে। বাদ দিতে হবে মিডিয়াকে শত্রু মনে করার প্রবণতাও— যা একেবারেই অপ্রীতিকর।
n লেখক : এডিটর-অ্যাট-লার্জ, সিএনএন
অনুবাদ: ফাইজুল ইসলাম
Comments