সবার আগে দরকার খাদ্য
ড. আর এম দেবনাথ১৮ আগষ্ট, ২০১৭ ইং
সবার আগে দরকার খাদ্য
বাজেট সমস্যা এবং প্রাকৃতিক কারণে চলতি অর্থবছরটি (২০১৭-১৮) ভালো যাবে বলে মনে হচ্ছে না। ‘ভ্যাটের’ আইন স্থগিত হওয়ায় বাজেট একটা ধাক্কা খেয়েছে। বিশ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব কম হবে। তার ওপর প্রকৃতি এবার বিরূপ আচরণ করছে। এ কারণে অনেক কিছু ওলট-পালট হয়ে যেতে পারে। গত ঈদের সময়ে যখন বাজেট, মানে নতুন বাজেট হয়, তখন দেশে সীমিত আকারে বন্যা হয়। বৃহত্তর সিলেট এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিস্তীর্ণ অঞ্চল অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের শিকার হয়। অতিবৃষ্টি পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে। ছয়-সাতটি জেলার ফসল নষ্ট হয়। গরু-বাছুর, ছাগল, হাঁস-মুরগি ভেসে যায়। মাছের খামারিরা বিপদগ্রস্ত হয়। অগণিত মানুষ নতুন করে ঋণগ্রস্ত হয়। এক ফসলি জমির দেশ সিলেট ও ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার কৃষকরা সারাবছরের ফসল হারিয়ে বাস্তবে রাস্তায় দাঁড়ান। সরকারি হিসাবেই ছয় লাখ টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়েছে। সাড়ে তিন কোটি টন বাত্সরিক ফসলের মধ্যে ছয় লাখ টন বোরো ধান কিছুই নয়। তবু এই খবরের পুরো সুবিধা নেয় চালকলের মালিকরা। সরকারি গুদামে চালের স্টক কম, সংগ্রহাভিযানে ব্যর্থতা এবং নতুন করে স্টক জোগাড়ে অসফলতা চালের বাজারকে অস্থিতিশীল করে ফেলে। যে চালের বাজার বর্তমান সরকারের আমলে সবচেয়ে স্থিতিশীল ছিল সেই চালের দাম ওঠে ৪০-৪৫-৫০ টাকায়। অসম্ভব একটা ঘটনা। আশার কথা, সেই পরিস্থিতি সরকার সামলে ওঠে। চাল আমদানির ব্যবস্থা হয়। চালের ওপর আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসে। জুলাই মাসের দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু বিধি বাম। সর্বশেষ খবর— প্রকৃতি এবার নতুন আক্রোশে ফুঁসে উঠেছে। চারদিকে বন্যার পদধ্বনি। ঢাকা শহরের লোক বন্যা নয়, বৃষ্টির জলেই বেসামাল। দু’এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকা জলে সয়লাব হয়ে পড়ে। বাসযোগ্য থাকে না ঢাকা শহর। এবার বৃষ্টি হচ্ছে খুবই বেশি। সারা দেশে বৃষ্টি। অঝোরে বৃষ্টি। মেঘের গর্জন বহুদিন শুনিনি, এবার শোনা যাচ্ছে। এখন দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। অনেকেই বলছেন— বিগত আট-দশ বছরের মধ্যে এত বৃষ্টি দেখা যায়নি। বাল্যকালে যেমন বৃষ্টি দেখেছি মনে হয় এমনই একটা অবস্থা। তার ওপর উজান থেকে নামছে জল। নেপাল, চীন ও ভারত আমাদের উজানের দেশ। আমাদের নদ-নদীগুলোর উত্স ঐসব দেশই। সেসব দেশেও প্রচণ্ড বন্যা পরিস্থিতি। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ আসাম বন্যার জলে ভাসছে। ডজন ডজন লোক মারা যাচ্ছে। ফসল তলিয়ে যাচ্ছে। বিহারের অবস্থাও তাই, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলও জলে ডুবেছে। বলা বাহুল্য, যতই ঐসব অঞ্চলের জল নিচের দিকে ধাবমান হচ্ছে, ততই আমাদের বন্যা পরিস্থিতিও জটিল হচ্ছে। এর সাথে যোগ হচ্ছে বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, দৈনিক বৃষ্টি। দৈনিক ইত্তেফাকের খবরের একটি শিরোনাম থেকেই পরিস্থিতি কী ভয়াবহ তা বোঝা যায়। খবরটির শিরোনাম হচ্ছে: ‘ভয়াবহ বন্যার পদধ্বনি’। খবরের ভেতরে বলা হচ্ছে, মাসব্যাপী বন্যা প্রলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রধান প্রধান তিন নদীতে জল বাড়ছে বলে ইত্তেফাকের খবরে বলা হয়েছে। বন্যার জল দেশের ২৭টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে সরকারের মন্ত্রী বলেছেন—পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি রয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে আরো জানা যাচ্ছে দেশের ২০টি জেলা কয়েকদিন যাবত্ বন্যা কবলিত। প্রতিদিনই নদ-নদীর জল বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি জলের ধারক যমুনা নদীর বাহাদুরাবাদ ঘাটে গত ৭০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে জল। চীন, নেপাল ও ভারতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। আগামী অমাবস্যার আর কয়েকদিন বাকি। তখন সমুদ্রের জলের উচ্চতা বাড়বে। বলা হচ্ছে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের পর এবারই প্রথম তিনটি নদীর জল এক সাথে বাড়ছে। এর ফলে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো ইতিমধ্যে জলের তলে ডুবেছে। দিনাজপুর শহর জলের তলে। শহরের লোকেরা কোমর জলে চলাচল করে। সৈয়দপুর বিমান বন্দর জলের তলে। বিমান চলাচল বন্ধ। বন্যার তোড়ে কুড়িগ্রামের রেললাইন ভেঙে পড়েছে, সেতু ভেঙে গেছে। ফলে উত্তরাঞ্চলের সাথে সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, ফুলছড়ি, বগুড়া, গাইবান্ধা, সরিষাবাড়ি, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এসব অঞ্চল ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত। সিলেটের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর জল বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুমিল্লা জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল, পাহাড়ি অঞ্চলও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের রাস্তাঘাট, পুল, ব্রিজ, রেলব্রিজ, রেললাইন ইত্যাদি প্রতিদিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি জলের দরে বিক্রি করতে চাইলেও কোনো ক্রেতা নেই। খাবারের অভাব, পানীয় জলের অভাব। রাস্তার উপরে বসবাস করার মতো জায়গাও নেই। অনেক জায়গায় রাস্তার ওপর দিয়ে জল বইছে। বন্যায় গোটা দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে কত লোক মারা যাচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই। কত শিশু জলের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে তার হিসাব কে  রাখে।

এমন সময়ে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসে উপস্থিত যখন আউশ ফসল ক্ষেতে এবং আমন লাগানোর সময় আসছে। আমনের চারা নষ্ট হয়ে গেছে। আউশের একটা জাত আছে যা ৮-১০ দিন জলের তলে থাকতে পারে এবং পরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু বন্যার জল কতদিন স্থায়ী হবে তা কেউ জানে না। অতএব আউশের ক্ষতি হবে অপূরণীয়। বন্যার জল দ্রুত নেমে গেলে হয়তো আমনের চারা লাগানোতে কোনো বিঘ্ন হবে না। কিন্তু বন্যার জল বিলম্বে নামলে আমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই পর্যন্ত কত পরিমাণ জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার চূড়ান্ত হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু ক্ষতিটা যে ব্যাপক হবে তা বলাই বাহুল্য। উত্তরাঞ্চলের জল যতই নীচের দিকে আসবে ততই দক্ষিণাঞ্চলের বিপদ বাড়বে তা বলাই বাহুল্য। এখানে বিবেচ্য হচ্ছে, কত খাদ্যশস্য উত্পাদন নষ্ট হবে। সিলেট ও কিশোরগঞ্জের গত বন্যায় গেছে ছয় লাখ টন। এবারের বন্যায় যে আরো বেশি ক্ষতি হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এমনিতে ৪০-৪৫ লাখ টন খাদ্যশস্য আমাদের আমদানি করতে হয়, তার ওপর বর্তমান প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এতে খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ যথেষ্ট বাড়বে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কাগজে দেখলাম ১৭-১৮ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হবে। এর অর্থ এটা অতিরিক্ত বোঝা, অতিরিক্ত খরচ সরকারের জন্য। এমনিতেই ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব ঘাটতি হবে বিপুল। তার ওপর এই আকস্মিক বোঝা অর্থমন্ত্রীর ঘুমকে হারাম করতে পারে। এছাড়া বাজারে দেখা যাচ্ছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। গতকাল কাঁচাবাজারে গিয়েছিলাম সব সবজিই আছে দোকানে। কোনো সবজির ঘাটতি নেই। কিন্তু দাম ৬০-৭০ টাকা কেজি। যে মূলা এক সময় কেউ খেত না, তার দামও ৭০ টাকা কেজি। এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। দোকানিরা বলে সরবরাহের অভাব। একথা তারা বরাবরই বলে। এবারও বলছে। একই কথা বলে উল্লেখ করা হচ্ছে যে, সবজি রপ্তানিও হ্রাস পেয়েছে। সবজি রপ্তানি হ্রাস পেলে তা তো অভ্যন্তরীণ বাজারে ভালো প্রভাব ফেলতে পারত। কিন্তু তা হচ্ছে কই? ফলে মধ্যবিত্তের দুর্দশা আবার বাড়ছে। যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল, বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি তা আবার চাপের মুখে পড়বে বলে মনে হয়। এতে দারিদ্র্য সীমার নিচে আবার কিছু লোক চলে যেতে পারে। এই মুহূর্তে মানুষের যা দরকার তা হচ্ছে—মুড়ি, চিড়া, গুড়, বাতাসা ও পানীয় জল।

এসবের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে কী? সবচেয়ে বড় কথা সুষ্ঠু বিতরণের ব্যবস্থা কী? পিঁপড়ায় যদি সব খেয়ে ফেলে তাহলে তো মানুষের কষ্টের কোনো সীমা থাকবে না। বৃষ্টি অতিবৃষ্টিতে ঢাকার রাস্তার কী অবস্থা তা আমরা সবাই প্রত্যক্ষ করছি। এমনিতেই এসব রাস্তার অবস্থা ছিল খারাপ। যেমন গুলশান-বাড্ডা-রামপুরা-মালিবাগ রাস্তা। কী হাল একথা কেউ কি জানেন? বৃষ্টিতে এর অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। আজ দেশের অবস্থাও তাই। বন্যা পরবর্তীকালে এসব মেরামতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে। খবরে দেখেছি প্রায় ৪০ শতাংশ রাস্তাঘাটের মেরামত কাজ হয়নি। তার ওপর বন্যা ও অতিবৃষ্টির ধাক্কা। কীভাবে সরকার এই টাকা জোগাড় করবে তা দেখার বিষয়। এবারের বাজেট বিশাল। কিন্তু রাজস্বের অভাব। বন্যা, ভয়াবহ বন্যা, বাজেটকে এলোমেলো করে দিতে পারে। তবে সবার আগে খাদ্য দরকার। জানি সরকার এব্যাপারে সচেতন। তবু সাবধান বলা রইল। চালের দাম, জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা থাকা দরকার এবং তা জরুরি ভিত্তিতে। একটুখানি অসাবধানতা সরকারের প্রচুর ক্ষতি করে ফেলতে পারে। ৮-৯ বছরের সুনাম নষ্ট করে ফেলতে পারে। অতএব সাবধান।

n লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

Popular posts from this blog

অবিবাহিত মেয়ের বুকে দুধ, এই ভিডিওটি অবশ্যই একা একা দেখবেন !

তৈরি করুন শীতের ভাপা পিঠা

টুইন টাওয়ারে ৯/১১ জঙ্গি হামলার ৫টি 'চমকপ্রদ' তথ্য