হিরোশিমার স্মৃতি মাতৃগর্ভেই তেজস্ক্রিয়তার শিকার


হিরোশিমা শান্তি স্মৃতি জাদুঘরের সামনে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন কোসেই মিতো l ছবি: প্রথম আলোকোসেই মিতোর জন্ম ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাসে। সময়ের হিসাবে তাঁর আণবিক বোমা হামলার ভুক্তভোগী হওয়ার কথা নয়। তবে তেজস্ক্রিয়তা হচ্ছে এমন এক সর্বগ্রাসী উপাদান, যা কিনা সবকিছু ভেদ করে মানুষকে আক্রান্ত করতে সক্ষম। কোসেই মিতোর বেলায়ও সেটা ঘটেছিল। তাই তিনি কনিষ্ঠ হিবাকুশাদের (হিরোশিমা বোমা হামলার শিকার) একজন হিসেবে স্বীকৃত।
কয়েক পুরুষ ধরে হিরোশিমায় বসবাস কোসেই মিতোর পরিবারের। বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক আর মা গৃহিণী। মা-বাবার সুখের সংসারে ছেলে কোসেইয়ের ভূমিষ্ঠ হওয়ার ক্ষণগণনার সবে শুরু। ঠিক সেই সময়টায় হিরোশিমায় আঘাত হানে আণবিক বোমা। মিতো পরিবারের বসবাস ছিল বোমা হামলার কেন্দ্রস্থলের স্বল্প দূরত্বের মধ্যে। ফলে দুর্ভাগ্য শুরু থেকেই পরিবারটির পিছু নিয়েছিল। কোসেইয়ের নানা ভেঙে পড়া ভবনের নিচে আটকে পড়ে প্রাণ হারান। পরের মাসে তেজস্ক্রিয়তাজনিত অসুখে ভুগে মারা যান তাঁর এক চাচা। বোমা হামলার তিন দিন পর মাকে হিরোশিমার বাইরে সরিয়ে নেওয়া হলেও তেজস্ক্রিয়তার হাত থেকে তাঁকে বাঁচানো যায়নি। স্কুলশিক্ষক বাবাকেও বাকিটা জীবনে নানা রকম শারীরিক যন্ত্রণায় ভুগতে হয়েছে।

পরের বছরের জানুয়ারিতে কোসেই জন্মানোর পর দেখা যায় তিনিও জন্মের আগে থেকেই তেজস্ক্রিয়তার দূষণে আক্রান্ত। ফলে জন্ম থেকেই শুরু হয় তাঁর বেঁচে থাকার সংগ্রাম। সেই সংগ্রামী জীবনে পড়াশোনা শেষ করে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্কুলশিক্ষকের চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। ৫৮ বছর বয়সে অবসরে যাওয়ার পর হিরোশিমা শান্তি উদ্যান ভ্রমণে আসা পর্যটকদের জন্য স্বেচ্ছাসেবী গাইডের কাজ করছেন। হিরোশিমার মর্মান্তিকতা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ থেকেই এই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসা। বিশেষ করে বিদেশিদের কাছে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি হিরোশিমার কথা বলে যাচ্ছেন। কারণ তাঁর মনে হয়েছে আনুষ্ঠানিক আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে হিরোশিমা বার্ষিকী পালিত হলেও কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটছে। সবকিছু সঠিকভাবে বলা হচ্ছে না। সেই তাগিদ থেকে একসময় একই ভাবনার অনুসারী আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন স্বেচ্ছাসেবী গাইডদের সংগঠন ফ্রি অ্যান্ড ইনফরমেটিভ গাইড।
কিছুদিন আগে হিরোশিমার শান্তি স্মৃতি উদ্যানে দেখা হয় মাতৃগর্ভে তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হওয়া কনিষ্ঠ এই হিবাকুশার সঙ্গে। মিতো বলেন, তাঁর স্কুলশিক্ষক বাবা ৯২ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আণবিক বোমা হামলা নিয়ে কখনো কোনো কথা বলেননি। তিনি নিজেও ভুগেছেন বোমার আঘাতে। তবে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা তাঁকে বাকশূন্য করে দিয়েছিল। মা তাঁর পরিবারের দুর্ভাগ্য নিয়ে আপনজনদের সঙ্গে কথা বললেও ঘরের বাইরে ছিলেন নিশ্চুপ। তিনি নিজেও শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার আগে হিরোশিমার ট্র্যাজেডির কথা বলে বেড়ানোর প্রয়োজনীয়তা সেভাবে অনুভব করেননি। তবে ৬০ বছর বয়সে তাঁর মনে হয়েছে তাঁদের ভুক্তভোগী প্রজন্ম শেষ হয়ে আসার মুখে। তাই এখন আর চুপ করে থাকা তাঁর চলে না। বিশেষ করে হিরোশিমার ক্ষয়ক্ষতি আর মানুষের দুর্দশার সঠিক বর্ণনা দেওয়া একমাত্র তাঁর মতো ভুক্তভোগীদের পক্ষেই সম্ভব। তাই সাইকেল চালিয়ে প্রায় প্রতিদিন তিনি চলে আসছেন শান্তি স্মৃতি উদ্যানে। আর জাপানি ও বিদেশি পর্যটকদের শোনাচ্ছেন সেই দুঃখভরা দিনগুলোর কথা।
শুধু তা-ই নয়। নিজেদের বিদায় নেওয়ার পর তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিরাও যেন সেই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসে, সে জন্য একদল তরুণকেও তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন স্বেচ্ছাসেবী গাইডের দলে যোগ দিতে। কোসেই মিতোর সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মাসাআকি মুরাকামি। অবসর সময়ে গাইডের কাজে তিনি জড়িত হয়েছেন এবং এখন পর্যন্ত নানা দেশের কয়েক হাজার হিরোশিমা ভ্রমণকারীর সামনে আণবিক বোমা হামলার মর্মান্তিক নানা রকম ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেছেন তিনি। মুরাকামি জানান, তাঁর সেই বিদেশি পর্যটকদের তালিকায় বাংলাদেশের ভ্রমণকারীরাও ছিলেন।
তরুণ প্রজন্মের দায়িত্ব পালনে এভাবে এগিয়ে আসাতে কোসেই মিতো আশ্বস্ত হয়েছেন যে হিরোশিমার স্মৃতি কখনো হারিয়ে যাবে না। এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার হিরোশিমা সফরে তিনি সন্তুষ্ট কি না, জানতে চেয়েছিলাম। বলেন, ওবামার সফরকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে হিরোশিমার মনোযোগ আকর্ষণ তাঁকে আনন্দ দিয়েছে। তবে মুখে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের কথা বলে গেলেও প্রকৃত অর্থে ঠিক উল্টো কাজ করে যাওয়া—ওবামার এই স্ববিরোধিতায় তিনি অসন্তুষ্ট।

আরও সংবাদ

Comments

Popular posts from this blog

অবিবাহিত মেয়ের বুকে দুধ, এই ভিডিওটি অবশ্যই একা একা দেখবেন !

টুইন টাওয়ারে ৯/১১ জঙ্গি হামলার ৫টি 'চমকপ্রদ' তথ্য

তৈরি করুন শীতের ভাপা পিঠা